উত্তর ইরাকের কিরকুক বিমানঘাঁটির সামরিক অংশে হঠাৎ চালানো রকেট হামলায় আহত হয়েছেন দুই নিরাপত্তা সদস্য। হামলার দায় এখনো কেউ স্বীকার করেনি, তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন—এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও উসকে দিতে পারে।
আকস্মিক রকেট হামলা: কী ঘটেছিল?
রবিবার (৩০ জুন) গভীর রাতে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় কিরকুক প্রদেশে অবস্থিত সামরিক বিমানঘাঁটির উপর আকস্মিকভাবে দুটি কাতিউষা রকেট হামলা চালানো হয়। এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, একটি রকেট ঘাঁটির সামরিক রানওয়ের কাছে বিস্ফোরিত হয়, অপরটি শহরের উরুবা এলাকায় একটি আবাসিক বাড়িতে আঘাত হানে।
এই ঘটনায় কিরকুক বিমানঘাঁটিতে কর্মরত দুইজন নিরাপত্তা সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে আহতদের অবস্থা স্থিতিশীল এবং তারা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নিরাপদে রয়েছেন।
কারা রয়েছে এই ঘাঁটিতে?
উল্লেখ্য, কিরকুক বিমানঘাঁটির সামরিক অংশে ইরাকি সেনাবাহিনী, ফেডারেল পুলিশ এবং ইরানপন্থী আধাসামরিক বাহিনীর জোট হাশেদ আল-শাবি (Popular Mobilization Forces – PMF) দীর্ঘদিন ধরেই অবস্থান করছে। এই বাহিনী এখন সরকারি সশস্ত্র বাহিনীর অংশ হিসেবে কাজ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘাঁটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে হামলা চালানো মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যে বার্তা দেওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে।
শহরেও আঘাত: আতঙ্কে স্থানীয়রা
সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি একটি রকেট কিরকুক শহরের একটি বসতবাড়িতে আঘাত হানে, যেটি ছিল উরুবা পাড়ায়। স্থানীয়দের দাবি, ঘটনার সময় বিকট শব্দে এলাকা কেঁপে ওঠে এবং অনেক বাসিন্দা রাতের আঁধারে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রাস্তায় নেমে আসে।
বাড়িটির মালিক জানান, “ভাগ্যক্রমে আমরা সবাই বেঁচে গেছি। তবে বাড়ির একটা অংশ ধসে পড়েছে। বাচ্চারা এখনো আতঙ্কে কাঁপছে।”
দায় স্বীকার করেনি কেউ, তবে সন্দেহের তীর কোথায়?
হামলার পরপরই ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী এলাকা ঘিরে ফেলে তদন্ত শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করেনি।
তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এ ধরনের হামলার পেছনে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী বা মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরোধিতাকারী মিলিশিয়া জড়িত থাকতে পারে।
ইরাকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা: বারবার একই চিত্র
এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে একাধিকবার ইরাকের বিভিন্ন অংশে মার্কিন ও ইরাকি ঘাঁটিতে রকেট এবং ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগেই, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মধ্যে বাগদাদ ও দক্ষিণ ইরাকের সামরিক ঘাঁটিগুলোর রাডার সিস্টেমে ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ড. ফারহান জাবের বলেন, “এই ধরনের হামলা সরাসরি যুদ্ধের সূচনা না করলেও এটি রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। কিরকুকের মতো এলাকা, যেখানে মার্কিন বা ইরাকি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে, সেখানে হামলা করে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা চালায় বিভিন্ন গোষ্ঠী।”
তিনি আরও বলেন, “এটি শুধু ইরাকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যই হুমকি নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।”
মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা আবার প্রশ্নের মুখে
কিছু রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই হামলার সময় ঘাঁটিতে কিছু মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন। যদিও তাদের কেউ আহত হননি, তবে এই ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—ইরাকে মার্কিন উপস্থিতি এখনো হুমকির মুখে।
স্মরণ করা যায়, ২০২৩ ও ২০২৪ সাল জুড়েই সিরিয়া ও ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিগুলোর উপর ৫০-এর অধিক হামলা চালানো হয়, যার অনেকগুলোর পেছনে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর হাত ছিল।
ইরাকের সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি
কিরকুকের অনেক সাধারণ বাসিন্দা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলছেন, তারা যুদ্ধ চায় না। একজন দোকানদার বলেন, “দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধ আর হামলায় আমরা ক্লান্ত। শান্তির মধ্যেই আমরা বাঁচতে চাই।”
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কোন পথে?
ইরাক সরকার জানিয়েছে, তদন্ত চলছে এবং দোষীদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখনো পর্যন্ত হামলার কোনো নিশ্চিত ক্লু মেলেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরাকি বা আন্তর্জাতিক বাহিনীর পাল্টা পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলতে পারে।
“এই হামলা শুধু সামরিক হুমকি নয়, বরং এটি ইরাকের পুনর্গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
—মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. ফারহান জাবের
শেষ কথা
এই রকেট হামলা আবারও প্রমাণ করল, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা এখনো স্বপ্নের মতো। ইরাকে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় নেতাদের একযোগে কাজ করতেই হবে।
তবে প্রশ্ন হলো, এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি আগামী দিনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এম আর এম – ০১২৮, Signalbd.com



