জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির বড় পরীক্ষা ছিল ডাকসু নির্বাচন

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে যেমন আলোচনার ঝড় বইছে, তেমনি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার দেওয়া হচ্ছে আশ্বাস—ফেব্রুয়ারিতেই নির্ধারিত সময় অনুযায়ী নির্বাচন হবে এবং তা হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য ডাকসু নির্বাচন ছিল এক ধরনের ‘টেস্ট’। সেই পরীক্ষায় শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে।
তিনি বলেন, “ডাকসু নির্বাচন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সেখানে কোনো সংঘাত বা সহিংসতা ঘটেনি। এটি প্রমাণ করে—সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় নির্বাচনও সম্ভব।”
সিরডাপ মিলনায়তনে মতবিনিময় সভা
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এই মন্তব্য করেন প্রেস সচিব।
সভাটির আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম নাগরিক কোয়ালিশন। শীর্ষক ছিল—“সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ: সফল নির্বাচন আয়োজনে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের করণীয়।”
সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি ছাড়াও নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন। আলোচনা ঘিরে একদিকে আশাবাদ, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ—দুটিই সমানভাবে উঠে আসে।
জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা: ফেব্রুয়ারিতেই ভোট
শফিকুল আলম জানান, সরকারের প্রতিদিনই নির্বাচনকে ঘিরে বৈঠক হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন—নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারিতে। কোনো অজুহাত বা চাপের কারণে এ নির্বাচন পেছানো হবে না।
তিনি আরও বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য মাঠে কাজ করবেন। তবে শুধু বাহিনীর উপস্থিতি যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। জনগণ যদি বন্যার পানির তোড়ের মতো ভোটকেন্দ্রে যায়, তবে কেউই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবে না।”
ডাকসু নির্বাচনে সাফল্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন সবসময় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দীর্ঘ বিরতির পর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনকে অনেকেই জাতীয় নির্বাচনের ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে দেখছিলেন।
কারণ—
- এটি দেশের সবচেয়ে বড় ছাত্র রাজনীতির নির্বাচন।
- এখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন।
- সুষ্ঠু ও সংঘাতমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়।
প্রেস সচিবের ভাষায়, “ডাকসু নির্বাচনে কোনো আইনশৃঙ্খলা সমস্যা হয়নি। শিক্ষার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছেন। তাই বলা যায়, এই নির্বাচন আমাদের জাতীয় নির্বাচনের জন্য বড় অনুপ্রেরণা।”
সরকারের সাফল্য ও সমালোচনা
সভায় শফিকুল আলম সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, “অনেকে অভিযোগ করছেন, সরকার কিছু করেনি। এগুলো বলা হচ্ছে হতাশা বা বঞ্চনার বেদনা থেকে। সরকারের কাজ মূল্যায়ন করতে হলে পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা দিয়ে বিচার করতে হবে।”
তিনি উদাহরণ দেন, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে অনেক দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এমন কোনো পরিস্থিতি হয়নি। এটিই সরকারের বড় সাফল্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইউটিউব বনাম মূলধারার গণমাধ্যম
প্রেস সচিব বলেন, “আজকাল তরুণ প্রজন্ম সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের বদলে ইউটিউব থেকে খবর নিচ্ছে। কিন্তু সেখানে নিয়মিত ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। কোনো সরকারই এসব সহ্য করে না। অথচ আমরা কিছু বললেই বলা হয়—অন্তর্বর্তী সরকার নাকি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ না হলে নির্বাচনকে ঘিরে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা
মতবিনিময় সভায় আলোচকরা বলেন, সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ—
- রাজনৈতিক দলগুলো যদি সহনশীল মনোভাব না দেখায়, তবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
- নাগরিক সমাজকে সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে ভুয়া তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
- নির্বাচন কমিশনকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ?
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের কথা বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন—
- রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব – সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পূর্ণ আস্থা তৈরি হয়নি।
- ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি – ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মিথ্যা প্রচার বাড়ছে।
- প্রার্থীদের আচরণবিধি মানা – নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকাতে সবার সদিচ্ছা জরুরি।
- ভোটারদের আস্থা ফেরানো – পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই শঙ্কিত।
কেন এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে বিশ্ব সম্প্রদায়ও দৃষ্টি রাখছে। এই নির্বাচন হবে—
- দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের বড় মোড়।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত।
- আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জনের সুযোগ।
ডাকসু নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির ‘টেস্ট’ বলা হলেও, প্রকৃত পরীক্ষা হবে ফেব্রুয়ারির ভোটে। সারা দেশের দৃষ্টি এখন সেই নির্বাচনের দিকে। সরকারের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সফলতার ওপর।
MAH – 12758, Signalbd.com