গাজায় ইসরায়েলের লাগাতার হামলা, নিহত আরও শতাধিক ফিলিস্তিনি

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের তীব্রতা কমার নাম নেই। মাত্র একদিনে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে আরও ১১৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মৃতদের মধ্যে অনেকেই মানবিক সহায়তা সংগ্রহের জন্য নিরাপদ আশ্রয় থেকে বের হয়েছিলেন। এ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে চলমান হামলায় মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজার ৮০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
বার্তাসংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য উদ্ধৃত করে জানা গেছে, গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা এখন ৬০,৮৩৯ জন। একই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজারের মতো ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আহত হয়েছেন ৮৬৬ জন। হাসপাতাল ও জরুরি সেবা কেন্দ্রগুলো অতিপ্রাচীন ও জনবহুল হয়ে পড়েছে।
মানবিক বিপর্যয় ও সাহায্যের সংকট
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও বহু মরদেহ রয়েছে, যেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নতুন শনাক্ত করা মরদেহের সংখ্যা ২৯০। বিশেষ করে মানবিক সহায়তা নিতে গিয়েই বেশিরভাগ প্রাণহানি ঘটছে। গত ২৪ ঘণ্টায় খাদ্য ও ওষুধ সংগ্রহ করতে গিয়ে ৬৫ জন নিহত এবং ৫১১ জন আহত হয়েছেন। চলতি বছরের ২৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত সহায়তা নিতে গিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৮৭ জন এবং আহতের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।
যুদ্ধবিরতি ভেঙে তাণ্ডব শুরু
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষে গত ১৮ মার্চ থেকে যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েল গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করে। এর ফলে এখনও পর্যন্ত ৯,৩৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ৩৭,৫৪৭ জন আহত। এ সময় বিভিন্ন বেসামরিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গৃহস্থালিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিচার
গাজায় ইসরায়েলের এই হামলার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগেও মামলা চলছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধবিধির লঙ্ঘন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
গাজার ভয়াবহ মানবিক সংকট: খাদ্য ও ওষুধের তীব্র অভাব
সাম্প্রতিক সময় গাজায় খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা এক বস্তা আটা বা দু’কেজি ডাল কিনতে চরম সমস্যায় পড়ছেন, মূল্য চড়া হওয়ায় এক পরিবারের পক্ষে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে উঠেছে। গাজার হাসপাতালগুলোতে ওষুধের ভীষণ অভাব দেখা দিয়েছে, যা অসুস্থ ও আহতদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
গাজার অনেক জায়গায় পানীয় জল ও বিদ্যুতের সংকট চলছে। দীর্ঘদিনের অবরোধের ফলে চিকিৎসাসেবা ও জরুরি সহায়তা পৌঁছানো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে।
গাজার মানুষের যন্ত্রণাময় জীবন
গাজায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের নাম। শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ সবার ওপর হামলার ছায়া নেমে এসেছে। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও অন্য যেকোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল এখন যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। খাদ্য সংকট ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাজার মানুষ দারুণ দুর্দশায় রয়েছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান এমন এক সময় চলছে যখন আন্তর্জাতিক মহল আবারও শান্তি আলোচনার ডাক দিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক হামলায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। বিশেষ করে জানুয়ারি মাসে হওয়া যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তি এখন কার্যত অকার্যকর।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ও ভবিষ্যৎ
বিশ্ব সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা গাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবিক সহায়তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে অবরোধ প্রত্যাহার এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি পুনঃস্থাপনের দাবি তুলেছে। কিন্তু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংঘাত এখনও দীর্ঘ ও জটিল, শান্তির কোনো স্থায়ী আশ্বাস দেখা যাচ্ছে না।
সারসংক্ষেপ
- গাজায় ইসরায়েলের সামরিক হামলায় মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৬০ হাজারের বেশি।
- একদিনে নিহত ১১৯ জন, আহত ৮৬৬ জন।
- মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে নিহতের সংখ্যা ১৪৮৭, আহত ১০ হাজারের বেশি।
- আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
- গাজার মানুষ খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপত্তার তীব্র অভাবে মানবিক বিপর্যয়ে রয়েছেন।
- বিশ্ব সম্প্রদায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও অবরোধ প্রত্যাহারের ডাক দিয়েছে।
MAH – 12117 , Signalbd.com