ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ, ৯ সেপ্টেম্বর। এই নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ এটি দীর্ঘ ৯ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচন চলাকালে কার্জন হলের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত অমর একুশে হলের ভোটকেন্দ্রে একজন শিক্ষার্থীকে অনিচ্ছাকৃতভাবে দুটি ব্যালট পেপার দেয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট পোলিং অফিসার জিয়াউর রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর জানিয়েছে, বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল এবং অভিযোগকারী ভোটারও এটি বুঝতে পেরেছেন। তবে ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ রাখতে বদ্ধপরিকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচনের পরিবেশ ও ভোটগ্রহণের তথ্য
নির্বাচন সকাল ৮টায় উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয়েছে এবং বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরাও ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন। এবারের ডাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯,৭৭৫ জন, যার মধ্যে ছাত্র ভোটার ২০,৮৭৩ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১৮,৯০২ জন। ২৮টি পদে ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মোট ৮টি কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রথমবারের মতো হলের বাইরে ভোটগ্রহণ
২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন আবাসিক হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি তুলেছিল, কারণ হলগুলোতে তখন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকায় ভোট প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে সে সময়কার প্রশাসন এই আশঙ্কাকে আমলে না নিয়ে হলেই ভোট গ্রহণ করে, যা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবারই প্রথম আবাসিক হলের বাইরে ডাকসু ও হল সংসদের ভোট গ্রহণ হচ্ছে। ক্যাম্পাসের নির্ধারিত ৮টি কেন্দ্রে (৮১০টি বুথ) শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন।
ভোটকেন্দ্র ও ভোটারদের তথ্য
নির্ধারিত ৮টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে কার্জন হল কেন্দ্রে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ৫,০৭৭ জন। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন, মোট ভোটার ৪,৮৫৩ জন। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) কেন্দ্রে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা ভোট দেবেন, মোট ভোটার ৫,৬৬৫ জন। উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে মাস্টারদা সূর্য সেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কবি জসীমউদ্দীন হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন, মোট ভোটার ৬,১৫৫ জন। ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্রে কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে, মোট ভোটার ৪,৪৪৩ জন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে শামসুন নাহার হলের ছাত্রীদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে, মোট ভোটার ৪,০৯৬ জন।
নির্বাচন পরিচালনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে পুলিশ, প্রক্টরিয়াল বডি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তার জন্য টিএসসি এলাকায় পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে ভোট গণনা সরাসরি দেখানো হচ্ছে।
প্রার্থীদের প্রতিক্রিয়া ও ভোটারদের উপস্থিতি
ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। সকাল থেকেই ভোটার শিক্ষার্থীরা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেন। এছাড়া, বিভিন্ন প্রার্থীরাও তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী শামীম হোসেন জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ভোট উৎসবমুখর ও সুষ্ঠু পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, আমরা আশাবাদী।” এছাড়া, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেছেন, “ভোট সুষ্ঠু হলে, ফল যাই হোক না কেন তা মেনে নেব।”
নির্বাচনে নতুন প্রার্থীদের উপস্থিতি
এবারের নির্বাচনে নতুন প্রার্থীদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ২৫টি পদে ২২৯ জন প্রার্থী ছিলেন, whereas এবারে ২৮টি পদে ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া, ১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে মোট ২৩৪ পদে গত নির্বাচনে ৫০৯ জন প্রার্থী ছিলেন, এবারে এই সংখ্যা ১,০৩৫ জন। এতে প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ বেড়েছে।
ডাকসু নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নমূলক গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান হয়েছে এবং হল দখল ও আধিপত্যের রাজনীতি এখন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে যাওয়া এখন আর শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যাকে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজানোর চেষ্টা করছে। এই পরিবর্তনগুলো টেকসই রূপ পাবে, ছাত্ররাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে—এসবই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫ একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ছাত্ররাজনীতির সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এভাবে, ডাকসু নির্বাচন কেবল একটি নির্বাচন নয়, বরং এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার একটি আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
MAH – 12714, Signalbd.com



