মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্তরা ভোটে দাঁড়াতে পারবে না, উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। একই সঙ্গে আইসিটি আইনের আওতায় চার্জশিট দাখিল হওয়া ব্যক্তিরা সরকারি চাকরিতেও বহাল থাকতে পারবেন না। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সিদ্ধান্তের বিস্তারিত
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও আইসিটি আইন সেকশন ৯(১)-এর অধীনে চার্জশিট পাওয়া ব্যক্তিরা কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। পাশাপাশি, এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর সরকারি চাকরিতেও তারা থাকতে পারবেন না।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অপরাধে জড়িত কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। এর ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও তার প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও নানা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা থেমে যায়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে সেই বিচার পুনরায় শুরু হয়।
তবে এতদিন পর্যন্ত কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে আইনগত স্পষ্টতা ছিল না। এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে বলা হলো যে, চার্জশিট পাওয়া মাত্রই অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার অধিকার হারাবেন।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ ছিল, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ক্ষমতার সুযোগ নিয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত বিচার প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে এবং অপরাধে জড়িতদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করবে। তবে কিছু সমালোচক প্রশ্ন তুলেছেন, চার্জশিট পর্যায়ের অভিযোগকে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা কতটা যৌক্তিক। তাদের মতে, আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে সম্পূর্ণভাবে অযোগ্য ঘোষণা করলে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের অগ্রগতি
প্রেস সচিব শফিকুল আলম আরও জানান, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। পাশাপাশি অন্য ১০টি কমিশনের ৩৬৭টি পরামর্শ বাস্তবায়নের কাজও চলছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে এসব কাজ সমন্বয় করছে।
এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রক্রিয়া সফলভাবে শেষ হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহিতা আরও সুদৃঢ় হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নতুন পরিকল্পনা
ব্রিফিংয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কেন্দ্র স্থাপন-২০২৫ প্রকল্পের অনুমোদন।
প্রেস সচিব বলেন, আগে বিদ্যুৎ খাতকে লুটপাটের খাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধুমাত্র গত বছরই এই খাতে ৬৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে ভর্তুকি কমানো এবং জনগণকে কম খরচে সহজে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান ও তুলনা
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ এখনো ফসিল ফুয়েল বা আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা থাকায় ভর্তুকির চাপ প্রতি বছর বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো গেলে শুধু অর্থনৈতিক চাপই কমবে না, পরিবেশগত দিক থেকেও বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জনগণের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে। তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নির্ভর করবে আইনের প্রয়োগ কতটা নিরপেক্ষভাবে করা যায় তার ওপর।
এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ অনুমোদন দেশের জ্বালানি খাতের ভবিষ্যৎকে টেকসই করতে পারে। তবে এর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
সারসংক্ষেপ
উপদেষ্টা পরিষদের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো একদিকে যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য করার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক খাতকে স্থিতিশীল করার দিকেও এগিয়ে নিচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার পদক্ষেপটি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই সিদ্ধান্ত বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, এবং এর ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কী ধরনের পরিবর্তন আসবে? বিশ্লেষকদের মতে, সময়ই এর উত্তর দেবে।
এম আর এম – ১১৮০, Signalbd.com