বাংলাদেশ

পাথর লুটের ঘটনায় হাইকোর্টের কড়া নির্দেশনা: ২০০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

Advertisement

ভোলাগঞ্জে পাথর লুটের ঘটনা: হাইকোর্টের নজরে বড় কেলেঙ্কারি

সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, যা দেশের অন্যতম বড় খনিজ সম্পদের উৎস হিসেবে পরিচিত, সেখানে ঘটে গেছে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। জানা গেছে, প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ জন ব্যক্তি গেজেটভুক্ত এই কোয়ারি এলাকা থেকে অবৈধভাবে সাদা পাথর লুট করে নিয়ে গেছে। বিষয়টি আদালতের নজরে আসার পর হাইকোর্ট কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল

আজ বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট ২০২৫) খনিজ সম্পদ ও পরিবেশ সচিবের পক্ষে হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, গত ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে এই পাথর লুটের ঘটনা ঘটে। পরে ১৫ আগস্ট তারিখে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কোম্পানিগঞ্জ থানায় মামলা নং-০৯ দায়ের করা হয়। মামলাটি দায়ের করা হয়েছে খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ এবং বিধিমালা ২০১২-এর ধারা ৯৩(১) অনুযায়ী। এছাড়াও পেনাল কোডের ৩৭৯ ও ৪৩১ ধারায় চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

মামলার মূল অভিযোগ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০০-২০০০ জন ব্যক্তি সমন্বিতভাবে সিলেটের গেজেটভুক্ত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে সাদা পাথর লুট করে। এই কাজের ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের পাশাপাশি পরিবেশেরও গুরুতর ক্ষতি হয়েছে। হাইকোর্ট এই ঘটনায় কঠোর অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

আদালতের নির্দেশনা: কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার দ্বৈত বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। শুনানিতে আদালত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন:

১. দায়ীদের তালিকা তৈরি ও মামলা:
কোম্পানিগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন দায়ী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে এফিডেভিট আকারে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে

২. পাথর প্রতিস্থাপন:
আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব সাদা পাথর লুট করা হয়েছে, সেগুলো স্থানীয় সিভিল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় সংগ্রহ করে ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে ফেরত আনতে হবে। এই কাজ ৭ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৩. নজরদারি ব্যবস্থা:
ভোলাগঞ্জ কোয়ারি এলাকায় দিন ও রাতের জন্য মনিটরিং টিম গঠন করতে বলা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের লুটপাট না হয়।

৪. বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন:
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে বুয়েটের একজন অধ্যাপক রয়েছেন। এই কমিটি ২ মাসের মধ্যে পরিবেশ ও আর্থিক ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে।

ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির গুরুত্ব

ভোলাগঞ্জ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাথর কোয়ারি এলাকা। এখানে উৎপাদিত সাদা পাথর নির্মাণ কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিবছর সরকার এই কোয়ারি থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। কিন্তু অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও চুরি করলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

পাথর কোয়ারি এলাকা থেকে পাথর সরালে নদীর তলদেশ নিচু হয়ে যায়, নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হয় এবং ভাঙন দেখা দেয়। এতে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকা ও রিট পিটিশন

এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর। এরপর জনস্বার্থে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (HRPB) হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। রিটে বলা হয়, পাথর লুটের কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

১৪ আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করে বিবাদীদের প্রতি নানা নির্দেশনা দেন। আদালত পরিবেশ সচিব ও খনিজ সম্পদ সচিবকে দায়িত্ব দেন যাতে তারা দ্রুত তদন্ত করে সঠিক ব্যবস্থা নেন।

সরকারি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা

এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশসহ পাঁচটি সংস্থা মাঠে নেমেছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, তারা এফিডেভিট আকারে রিপোর্ট প্রস্তুত করছে। পাশাপাশি ভোলাগঞ্জ এলাকায় কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে, যাতে পুনরায় এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।

পরিবেশগত ক্ষতির হিসাব কেমন হতে পারে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাথর সরিয়ে নিলে শুধু আর্থিক ক্ষতি হয় না, পরিবেশেরও বড় ধরনের ক্ষতি হয়। নদীর প্রবাহ পরিবর্তিত হওয়া, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, মাটির গুণগত মান নষ্ট হওয়া—এসব মিলিয়ে এই ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।

বুয়েটের প্রফেসরসহ গঠিত কমিটি এই ক্ষতির সঠিক হিসাব করবে এবং সে অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভবিষ্যৎ করণীয়: কী হতে পারে সমাধান?

অবৈধ পাথর উত্তোলন রোধে প্রযুক্তি ব্যবহার: ড্রোন, সিসিটিভি নজরদারি।
সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা জোরদার: বিজিবি ও র‌্যাবের মোতায়েন বাড়ানো।
লাইসেন্স ও কোয়ারি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজেশন: অনিয়ম কমাতে অনলাইন মনিটরিং।
আইনি শাস্তি কঠোর করা: যাতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস না পায়।

ভোলাগঞ্জের পাথর লুট শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদ নয়, বরং দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্যও বড় হুমকি। হাইকোর্টের পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি এবং কার্যকর নজরদারি চালু হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে।

MAH – 12532 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button