
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক—বাংলাদেশ ব্যাংক—বর্তমান অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রোববার (১১ আগস্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩০ দশমিক ২৫ বিলিয়ন (৩ হাজার ২৫০ কোটি) মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত কয়েক মাসে চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে বাজার থেকে ডলার কিনে এই রিজার্ভ বৃদ্ধি করেছে।
ডলার কেনার মাধ্যমে রিজার্ভ বৃদ্ধির বিশদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে মোট ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার কেনে। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২১ দশমিক ৪৭ থেকে ১২১ দশমিক ৫০ টাকা। এর আগে গত ২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১২১ দশমিক ৯৫ টাকায় ১ কোটি ডলার এবং ১৩ ও ১৫ জুলাই মোট ৪৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার নিলামে কেনার তথ্য পাওয়া যায়। চলমান এই নিলাম প্রক্রিয়ায় মোট ৫৮ কোটি ডলার কেনা হয়েছে।
বাজারে এই উদ্যোগ মূলত ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস ধরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের প্রাপ্যতা বেড়েছে এবং এতে ডলারের দর কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। দাম কমে গেলে রপ্তানিকারক এবং প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাতে অনিচ্ছুক হতে পারেন, যা দেশের মুদ্রাবাজারকে প্রভাবিত করে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাজারে সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: আইএমএফ-এর BPM-৬ পদ্ধতির প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর ব্যালেন্স অব পেমেন্টস ও ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (BPM-৬) পদ্ধতির মাধ্যমে রিজার্ভ পরিমাণ ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রেকর্ড করা হয়েছে। BPM-৬ হল একটি মানসম্মত হিসাব পদ্ধতি, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পেমেন্ট ব্যালেন্স এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্পর্কিত তথ্যের হিসাব রাখে।
গত ৪ আগস্ট দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার এবং BPM-৬ অনুযায়ী ২৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। চলমান অর্থনৈতিক নীতিমালা ও বিশ্ববাজারের ওঠানামার মধ্যে এই মজুত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বড় সূচক।
প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ও এর প্রভাব
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয়ের প্রবাহে ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। জুলাই মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২৪৭ কোটি ডলার (২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার), যা গত বছরের একই মাসের ১৯১ কোটি ডলারের তুলনায় অনেক বেশি। এই প্রবৃদ্ধির ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ার পাশাপাশি রিজার্ভ মজুতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে সরকারের বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ যেমন অবৈধ পথে অর্থ পাঠানো বন্ধ করা এবং বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়ার ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে বৈধ রেমিট্যান্স বেড়েছে, যা দেশের মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা এনেছে।
ডলারের দাম ও বাজার পরিস্থিতি
বর্তমানে দেশি ব্যাংক ও বেসরকারি বাজারে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমেছে। এতে ডলারের বিনিময় হার নিম্নমুখী হলেও বাজারে দরপতন রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে। ডলারের দাম খুব বেশি কমলে রপ্তানিকারক এবং প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাতে সংকোচ করতে পারেন, যা রিজার্ভ সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ শেষে লেনদেনের ভারসাম্য উন্নত হওয়ায় ডলারের উপর চাপ কমেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ওপর বিদেশি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফিরেছে।
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ সব বিদেশি বকেয়া ঋণ সফলভাবে পরিশোধ করেছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ ও মুদ্রা প্রবাহের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও মুদ্রানীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গত অর্থবছরের রেমিট্যান্স
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন। যা দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য মজবুত ভিত্তি তৈরি করেছে। তবে অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং রিজার্ভ মজুত বৃদ্ধি অপরিহার্য।
সার্বিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো মানে দেশের মুদ্রানীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এই মজুত দেশের আমদানি খরচ, বাণিজ্য স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক বৃদ্ধির ফলে দেশের মুদ্রাবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়তা করবে।
তবে রেমিট্যান্সের ওপর উচ্চ নির্ভরশীলতা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই বৈদেশিক মুদ্রার উৎস বহুমাত্রিক করা এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির শক্তি বৃদ্ধি করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ডলার ক্রয় এবং রিজার্ভ বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও মুদ্রানীতির স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রবাসী আয়ের বৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আন্তর্জাতিক আস্থার ফেরত আসায় রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি ডলারের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সফলতা দেখাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করার আশা করা যাচ্ছে।
MAH – 12250 , Signalbd.com