বাংলাদেশ

তিস্তা নদীতে স্বপ্নপূরণ মওলানা ভাসানী সেতুর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

Advertisement

উত্তরবঙ্গের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যে স্বপ্ন বুকে লালন করছিল, অবশেষে তা বাস্তবে রূপ নিলো। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ঘাট এবং কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার মধ্যে তিস্তা নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত ‘মওলানা ভাসানী সেতু’। ২০ আগস্ট ২০২৫, বুধবার দুপুরে এই সেতুর উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।

উদ্বোধনের পর মুহূর্তেই হাজারো মানুষের ভিড়ে তিস্তার পাড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফিতা কেটে সেতুর দ্বার খুলে দেওয়া হলে জনতা উল্লাসে মেতে ওঠে। কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে, কেউ দল বেঁধে সেতুর ওপর উঠে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। কেউ ছবি তোলে, কেউ আবার ভিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। যেন এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা হলো উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনে।

সেতুর ইতিহাস ও দীর্ঘ প্রতীক্ষা

এই সেতুর স্বপ্ন শুরু হয়েছিল অনেক বছর আগে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শরিতুল্যাহ মাস্টার ১৯৯৫ সাল থেকে এ সেতুর জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসেন। তিনি ‘তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করেন এবং ধারাবাহিকভাবে সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়।

২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। কিন্তু নানা জটিলতা, অর্থায়ন এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বারবার বিলম্ব হয়। অবশেষে ১১ বছর পর সেই সেতুটি বাস্তবে রূপ নিলো।

নির্মাণ ও বৈশিষ্ট্য

এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, ১৪৯০ মিটার দীর্ঘ ও ৯.৬ মিটার প্রস্থের এই পিসি গার্ডার সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে এলজিইডির সবচেয়ে বড় প্রকল্প।

  • মোট ব্যয়: ৮৮৫ কোটি টাকা
  • অর্থায়ন: সৌদি সরকার
  • নির্মাণ সংস্থা: চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড
  • অতিরিক্ত অবকাঠামো: ৮০ কিলোমিটার এক্সেস রোড, ৫৮টি বক্স কালভার্ট, ৯টি আরসিসি সেতু

ফলে শুধু একটি সেতুই নয়, বরং একটি বৃহৎ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।

অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা

সেতুটি চালু হওয়ার ফলে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

  1. কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ হবে – গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান কৃষি উৎপাদন এলাকা। ধান, ভুট্টা, আলু ও সবজি স্বল্প খরচে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো যাবে।
  2. শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে – সহজ যোগাযোগের কারণে ছোট ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে।
  3. ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ – ঢাকায় যাতায়াত সহজ ও দ্রুত হবে।
  4. ভুরুঙ্গামারী স্থলবন্দর কাছে আসবে – দূরত্ব কমবে প্রায় ৪০–১০০ কিলোমিটার, ফলে আমদানি-রপ্তানির খরচও কমবে।

স্থানীয় বাজার ও ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা

সেতুটি চালু হওয়ার ফলে গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের অন্তত ১০টি প্রধান বাজার সরাসরি সংযুক্ত হবে। এর মধ্যে রয়েছে—

  • বেলকা বাজার
  • পাঁচপীর
  • ধর্মপুর
  • হাট লক্ষ্মীপুর
  • সাদুল্যাপুর
  • ধাপেরহাট

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, আগে নদী পারাপারে সময় ও খরচ অনেক বেশি হতো। এখন সহজে পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে।

পর্যটনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

তিস্তা নদীকে ঘিরে নতুন পর্যটন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে সেতুটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

  • সেতুকে কেন্দ্র করে নতুন দর্শনীয় স্থান তৈরি হবে।
  • স্থানীয় হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পরিবহন খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
  • বর্ষাকালে তিস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকের ভিড় বাড়বে।

নামকরণ নিয়ে বিতর্ক

যদিও উদ্বোধনের আনন্দ সর্বত্র, তবে নামকরণ নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ রয়ে গেছে। স্থানীয়রা চান সেতুর নাম দেওয়া হোক ‘শরিতুল্যাহ মাস্টার তিস্তা সেতু’, যিনি ছিলেন আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা। কিন্তু সরকার গত ১০ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে এর নাম রাখে ‘মওলানা ভাসানী সেতু, গাইবান্ধা’

অনেকের মতে, মওলানা ভাসানী ছিলেন কৃষক ও শ্রমিকের নেতা, তাই তাঁর নামে নামকরণ যথাযথ। তবে শরিতুল্যাহ মাস্টারের অবদানও স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি উঠেছে।

সাধারণ মানুষের আনন্দ

উদ্বোধনের দিন হাজারো মানুষ সেতুর ওপর ভিড় জমায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই নতুন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে। অনেকের চোখে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে। একজন বৃদ্ধ কৃষক বলেন—

“আমাদের জীবনে এমন দিন আসবে ভাবিনি। এখন ধান-আলু বাজারে নিতে আর কষ্ট হবে না।”

আরেকজন শিক্ষার্থী জানান—

“এখন থেকে ঢাকা যেতে অনেক সময় বাঁচবে। পড়াশোনা ও চাকরির সুযোগও বাড়বে।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সেতুটি শুধু একটি অবকাঠামো নয়, বরং উত্তরাঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতীক। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সরাসরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে।

নির্মাণ প্রকৌশলীরা বলছেন, সেতুটি তিস্তার পানি প্রবাহ মাথায় রেখে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে এটি দীর্ঘদিন টিকে থাকবে।

সব বিতর্ক ও বিলম্বের পর অবশেষে উত্তরাঞ্চল পেল তাদের স্বপ্নের সেতু। মওলানা ভাসানী সেতু শুধু একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, বরং একটি নতুন যাত্রার সূচনা। কৃষি, শিল্প, পর্যটন ও জনজীবনে এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে।

তিস্তার দুই তীরের মানুষ আজ সত্যিই বলতে পারে—
“আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, শুরু হলো নতুন পথচলা।”

MAH – 12432 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button