জাতিসংঘসদর লন্ডনে আবারও উত্তেজনার ছাপ
লন্ডন—বিশ্বের অন্যতম কূটনৈতিক কেন্দ্র, যেখানে প্রায় সব বড় দেশ ও রাজনৈতিক অঞ্চল তাদের মিশন স্থাপন করেছে। শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক পরিবেশের জন্য পরিচিত এই শহরে হঠাৎই বড় ধরনের নিরাপত্তা প্রশ্ন উঠে এসেছে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে ইসরাইলপন্থিদের হামলার পর। বুধবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’-এ দেয়া বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি দূতাবাস কর্তৃপক্ষ জানায় যে, মুখোশধারী একদল লোক ইসরাইলি পতাকা হাতে দূতাবাস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে ভাঙচুর চালিয়েছে।
এই ঘটনাকে শুধুমাত্র একটি ‘উদ্ভট আচরণ’ নয় বরং সুপরিকল্পিত উসকানি হিসেবে দেখছে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকেরা।
ঘটনাটি কীভাবে ঘটল? প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান
দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
“বেশিরভাগই মুখোশধারী কয়েকজন ব্যক্তি ইসরাইলি পতাকা হাতে দূতাবাস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। তারা দূতাবাসের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে জায়গায় জায়গায় উসকানিমূলক স্টিকার লাগায় এবং ভবনের সামনের কিছু অংশ ভাঙচুর করে।”
ভিডিও এবং ছবিতে দেখা যায়—
- ইসরাইল ও যুক্তরাজ্যের পতাকা হাতে দাঁড়ানো একদল ব্যক্তি,
- দূতাবাসের প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে উচ্চস্বরে স্লোগান,
- মুখোশধারী কয়েকজনের ক্যামেরার সামনে পোজ দেওয়া,
- ভবনের দেওয়ালে লাগানো স্টিকার:
- ‘ইহুদিবাদ-বিরোধীতা বর্ণবাদ’
- ‘আমরা ভীতু ইহুদি নই’
- ‘আমি ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে ভালোবাসি’
এসব স্টিকার ও আচরণ স্পষ্টভাবেই ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক উপস্থিতিকে অপমানের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে।
কূটনৈতিক ভবনে হামলা—আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন
ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কোনও দেশের দূতাবাসে হামলা বা তাণ্ডব আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। দূতাবাস হলো সেই দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সেখানে হামলা মানে ঐ দেশের কূটনৈতিক মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত।
যুক্তরাজ্য একটি আইননিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এ কারণেই ফিলিস্তিনি দূতাবাস বৃটিশ সরকারের কাছে জরুরি নিরাপত্তা বাড়ানোর আবেদন করেছে।
ফিলিস্তিনি দূতাবাসের দাবি—“তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক নিরাপত্তা”
দূতাবাস কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরকে লিখিতভাবে জানিয়েছে তারা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
তাদের দাবি—
- দূতাবাস ভবন ও কর্মীদের চারপাশে স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা
- হামলায় জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত ও গ্রেপ্তার
- কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোতে ভবিষ্যতে হামলা ঠেকাতে বিশেষ নজরদারি
দূতাবাস আরও বলেছে—
“এই আক্রমণ আমাদের নিরুৎসাহিত করতে পারবে না। আমরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কাজে অবিচল থাকব এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকব।”
যুক্তরাজ্যের নীরব প্রতিক্রিয়া—কেন তারা এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি?
ঘটনার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা সম্ভবত পুলিশি তদন্ত শুরুর আগে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে নারাজ।
তবে সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন কূটনৈতিক মহলে নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—
- এটি কি ব্রিটিশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপের ফল?
- লন্ডনে ফিলিস্তিন–ইসরাইল ইস্যু নিয়ে বাড়তে থাকা বিক্ষোভ কি কর্তৃপক্ষকে দ্বিধায় ফেলেছে?
- সরকার কি বিশেষভাবে ইসরাইল–সমর্থন বা ফিলিস্তিন–সমর্থনের ইস্যুতে সাবধানতা অবলম্বন করছে?
এ প্রশ্নগুলোর জবাব সময়ই দেবে।
যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি: ফিলিস্তিন–ইসরাইল ইস্যুতে টানাপোড়েন
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্যে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ করছে। একই সময়ে ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীও নিজস্ব অবস্থান থেকে বিক্ষোভ ও পথসভা করছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লন্ডনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে—
- ইসরাইলপন্থিদের পাল্টা–মিছিল
- অ্যাণ্টি–সেমিটিজম এবং ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ
- পুলিশের ওপর অতিরিক্ত চাপ
- সংসদে বিষয়টি নিয়ে তীব্র বিতর্ক
এমন পরিস্থিতিতে একটি কূটনৈতিক মিশনে হামলা হওয়া বিষয়টিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।
কেন এই হামলার সময়টি গুরুত্বপূর্ণ?
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, হামলাটি এমন সময় ঘটল যখন—
- গাজায় মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার তীব্রতা বেড়েছে,
- ইসরাইল–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে,
- ইউরোপে ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী,
- ইসরাইলপন্থি উগ্রগোষ্ঠীগুলো নিজেদের অবস্থান প্রদর্শনে আরও আক্রমণাত্মক হচ্ছে।
তাই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, হামলাটি প্রতীকী বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।
আগেও কি এমন ঘটনা ঘটেছে? প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ
গত কয়েক বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিন বা ইসরাইলপন্থিদের দ্বারা ভাঙচুর, হামলা বা উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যেমন—
- জার্মানির বার্লিনে ইসরাইলপন্থিদের বিক্ষোভে ফিলিস্তিনি প্রতিষ্ঠানে হামলা
- ফ্রান্সে ইহুদি প্রতিষ্ঠানে ভয়ভীতি
- নেদারল্যান্ডসে ফিলিস্তিনপন্থি অফিসে আগুন লাগানোর প্রচেষ্টা
তবে যুক্তরাজ্যে কোনও কূটনৈতিক দূতাবাসে এমন প্রবেশ ও ভাঙচুর সাম্প্রতিক কালের মধ্যে প্রথম।
ফিলিস্তিন–ইসরাইল সম্পর্কের ইতিহাসে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা
এই ঘটনাকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক ভূমিকা—
- ১৯১৭ সালের বেলফোর ডিক্লারেশন,
- ব্রিটিশ ম্যান্ডেট প্যালেস্টাইন শাসন,
- আরব–ইহুদি সম্পর্কের জটিলতা তৈরি,
- ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা।
ফিলিস্তিনিদের কাছে যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—অতীতে তাদের ভূমিকায় সমালোচনা থাকলেও বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইস্যুতে যুক্তরাজ্য তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ।
তাই লন্ডনে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে হামলা অনেকের চোখে দ্বৈত প্রতীকি গুরুত্ব বহন করে—
- একদিকে ফিলিস্তিনের ওপর সরাসরি আক্রমণের ইঙ্গিত
- অন্যদিকে ব্রিটিশ ভূখণ্ডে ইসরাইলপন্থি উগ্রপন্থিদের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: এটি শুধু ভাঙচুর নয়; রাজনৈতিক বার্তা
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন—
- হামলাটি পরিকল্পিত
- উদ্দেশ্য উসকানি সৃষ্টি
- লন্ডনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি প্রভাবিত করার চেষ্টা
- দূতাবাসকে ভীত করার প্রচেষ্টা
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন—
“এ ধরনের আক্রমণ সাধারণত সংগঠিত গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়। মুখোশধারী অবস্থায় ভিডিও ধারণ করা, স্টিকার লাগানো, পতাকা হাতে দাঁড়ানো—এসবই প্রতীকী বার্তা।”
যুক্তরাজ্যের মুসলিম ও আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ
লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার ও লুটনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বড় মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের সমর্থন দীর্ঘদিনের।
দূতাবাসে হামলার পর অনেক সংগঠন বলছে—
- এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ভয় দেখানোর চেষ্টা
- ইসরাইল–ফিলিস্তিন ইস্যুকে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমাজে বিভক্তি তৈরির হাতিয়ার বানানো হচ্ছে
- সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে
আসলে কারা ছিল হামলাকারী? তদন্ত কোথায় দাঁড়িয়েছে
যদিও মুখোশধারী থাকার কারণে তাদের পরিচয় এখনও নিশ্চিত নয়, কিন্তু ভিডিও দেখে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন—
- এটি একটি সংগঠিত ইসরাইলপন্থি উগ্রগোষ্ঠীর কাজ
- হামলার আগে এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে
- স্টিকার প্রস্তুত করে আনা হয়েছিল
- ক্যামেরা সিস্টেম এড়ানোর কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে
ব্রিটিশ পুলিশ ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করেছে।
এটি কি যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক নিরাপত্তার ব্যর্থতা?
আলাদা প্রশ্ন হলো—
কিভাবে দূতাবাসের সামনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকায় হামলাকারীরা এত সহজে ঢুকে পড়ল?
বিশেষ করে—
- গাজায় যুদ্ধ,
- লন্ডনে বিক্ষোভ,
- মধ্যপ্রাচ্য-সংক্রান্ত উত্তেজনা—
এগুলো বিবেচনায় নিয়েও যদি কোনও স্থায়ী নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে তা যে বড় ধরনের নিরাপত্তা শৈথিল্য, সাংবাদিকরা তা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করছেন।
ফিলিস্তিনপন্থিদের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিন সমর্থনকারী সংগঠনগুলো বলেছে—
- হামলাটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অপমান
- কূটনৈতিক সম্পর্ক আঘাতপ্রাপ্ত
- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সতর্ক হতে হবে
- ইসরাইলপন্থি উগ্রবাদ বাড়ছে
এ ছাড়া মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বেগ জানিয়েছে।
ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব: ব্রিটিশ নীতি কি বদলাবে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ঘটনার ফলে—
- যুক্তরাজ্য কূটনৈতিক ভবনগুলোর নিরাপত্তা বাড়াতে বাধ্য হতে পারে
- ফিলিস্তিন ইস্যুতে ব্রিটেন আরও সতর্ক অবস্থান নিতে পারে
- সংসদে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হতে পারে
- ব্রিটিশ মুসলিম জনসমাজ সরকারের প্রতি আরও চাপ দেবে
কূটনৈতিক ভবন নয়, আঘাত লেগেছে শান্তির ভিত্তিতে
লন্ডনে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে এই হামলা শুধু একটি ভবনের ওপর আক্রমণ নয়। এটি সমগ্র কূটনৈতিক পরিবেশ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার ওপর আঘাত।
যে শহর বিশ্ব শান্তির প্রতীক, সেখানে এ ধরনের ঘটনা শুধু উদ্বেগ বাড়ায় না—বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতা আরও তীব্র করে।
ফিলিস্তিনি দূতাবাসের বক্তব্য স্পষ্ট—
“আমরা পিছিয়ে যাব না।”
এখন অপেক্ষা ব্রিটিশ সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের।
MAH – 14122 I Signalbd.com



