আজকের দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন — ৫ আগস্ট। এই দিনে এক বিশাল ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৬ বছরব্যাপী স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটে। এক জনজীবন-মুক্তির লড়াই, যেখানে স্বপ্ন বোনা হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যবিহীন ও স্বাধীন বাংলাদেশের। এই দিনটি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিন নয়, বরং ছিল এক সমগ্র জাতির নতুন সূচনার দিন।
৫ আগস্টের ঐতিহাসিক পটভূমি: স্বৈরাচারের ছায়া থেকে মুক্তির আলোকবর্তিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা একটি কালো অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। এই শাসনের অধীনে মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছিল। রাষ্ট্রের উচ্চস্তরের নানা কর্মকর্তার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সাধারণ মানুষের জীবনে বৈষম্য ও অত্যাচারের সৃষ্টি করেছিল। এই অবস্থা থেকে মুক্তির ডাক দিয়েছিল প্রধানত ছাত্র সমাজ, যারা ছিল দেশের আদর্শবাদী ভবিষ্যৎ।
ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে বিপ্লবের সূচনা
২০১৮ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন। ছাত্ররা বলেছিল, “বৈষম্য বন্ধ কর, স্বচ্ছ সুযোগ দাও”। এই ছোট্ট দাবির পেছনে লেগে গেলো পুরো জনসমাজ। শুধু ছাত্ররাই নয়, তাদের সাথে যোগ দিলেন শিক্ষক, কর্মচারী, সাধারণ মানুষ, এমনকি বয়স্করা যারা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন বেড়ে উঠে এক বিশাল জনজাগরণের রূপ নিয়ে। এ আন্দোলনে কারো চাকরি হারানোর ভয়ে ভয় পেলেও, তারা সাহসী হয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়।
৫ আগস্ট: টানাটানি থেকে জনতাবিরাজ্য গড়ার দিন
৫ আগস্টের সকালটা ছিল নিঃসঙ্গ, শহর যেন নিস্তব্ধ ছিল। কিন্তু দুপুরের পর মানুষের ঢল বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ লংমার্চ করে ঢাকায় এসে যোগ দেয়। মায়েরা, যারা সন্তানদের নিরাপত্তায় সর্বদা উদ্বিগ্ন, তারা সামিল হয়। বাবারা, যারা শাসকগণের কাছে ভয় পেয়ে সন্তানদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন, তারা আবার সাহস নিয়ে রাস্তায় নামেন। শহীদ পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা, চাকুরিজীবী—সবাই মিলেমিশে বিক্ষোভে যোগ দেয়।
স্বৈরাচারী সরকারের পতন: গণভবন থেকে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাসীনরা
তৎকালীন সরকার প্রধান, যিনি দাবি করতেন, “শেখ হাসিনা পালায় না,” ৫ আগস্ট গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যান। প্রথমে বিমান বাহিনীর এমআই-১৭ হেলিকপ্টারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু বিমানঘাঁটিতে। পরবর্তীতে সেখান থেকে সি১৩০ জুলিয়েট হারকিউলিস বিমানযোগে ভারতের গাজিয়াবাদের হিন্দোন বিমানঘাটিতে চলে যান। তাঁর পালানোর খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জনতাবিরাজ্য থেকে দেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনার সূচনা হয়।
সেনাপ্রধানের ঘোষণা: স্বৈরাচার পতনের নিশ্চিত বার্তা
সকাল থেকেই উত্তেজনা ও অবিশ্বাসের মধ্যে দিনটি কাটছিল। বিকেল ৩ টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ঘোষণা দেন, “দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন স্বৈরাচারী সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।” এই ঘোষণার সাথে সাথে সারা দেশে বিজয় উল্লাস শুরু হয়। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এমনকি রাজপথগুলো মানুষের ঢলেময় হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আনন্দে মেতে ওঠে।
গণভবনে ছাত্র-জনতার উচ্ছ্বাস, ভাংচুর ও শহীদদের স্মরণ
গণভবনে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষ কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষে বসবাস শুরু করে। সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের স্লোগান দেয়াল পুড়িয়ে দেয়। তারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জয়গান গায়। ছাদ থেকে তারা উল্লাস করে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলে। তবে এই আনন্দের মাঝে পুলিশি বেচালতায় যাত্রাবাড়ি ও আশুলিয়ায় নৃশংসতা ঘটে। যাত্রাবাড়ি পুলিশ স্টেশনের সামনেই নিহত হন ৫৫ জনের বেশি। আশুলিয়ায় পুড়িয়ে মারা হয় ৬ জন। এদিন আন্দোলনরতরা কয়েকটি থানায় আগুন দেয়, ভাঙচুর চালায়।
নতুন বাংলাদেশের সূচনা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা ও রাজনৈতিক সমঝোতা
এই ঐতিহাসিক বিজয়ের দিনে সেনাপ্রধান ঘোষণা দেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে দেশের কার্যক্রম চালানো হবে। বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি, জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক পক্ষ অংশ নেয়। প্রজন্মের এই লড়াই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করে — যেখানে গণতন্ত্র, সমানাধিকার ও ন্যায়বিচার থাকবে অটুট।
৫ আগস্টের শিক্ষা ও প্রভাব: নতুন প্রজন্মের জন্য এক বিপ্লবী দৃষ্টান্ত
যদিও ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম নয়, এই প্রজন্ম তাদের সাহস ও আত্মত্যাগ দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছে। স্বৈরাচার পতনের এই দিনটি প্রমাণ করেছে, দেশের প্রকৃত শক্তি হলো জনগণ। তাদের ঐক্য, দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসই পারে দেশকে বদলে দিতে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথের সূচনা ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক বিজয়ে।
৫ আগস্ট — বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয়
৫ আগস্ট শুধু একটি দিন নয়, এটি হলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক অনন্য উৎসব। ছাত্র-জনতার অসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের ফলে দেশের উপর থেকে স্বৈরাচারের অন্ধকার দূর হয়। এই দিন আমাদের শেখায়, ঐক্যবদ্ধ হলে অসাধ্য সাধন সম্ভব, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই সর্বদা চালিয়ে যেতে হবে।
MAH – 12132, Signalbd.com



