বাংলাদেশ

গুম-নির্যাতন-ক্রসফায়ারের নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসতো: আইজিপি মামুন

Advertisement

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সম্প্রতি আদালতে দেওয়া এক বিস্ফোরক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তার দায়িত্বকালীন সময়ে গুম, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের মতো ঘটনাগুলোর অধিকাংশ নির্দেশনা আসতো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে। তিনি দাবি করেন, এসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অনেক সময় পুলিশ বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে আলাদা গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক উপদেষ্টাদের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

জবানবন্দিতে কী বললেন মামুন

২০২৫ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে দেওয়া ৫ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে মামুন বিস্তারিতভাবে তার দায়িত্বকালীন সময়ের নানা অন্ধকার দিক তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, “যেসব গুরুতর নির্দেশনা থাকতো, সেগুলো প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সরাসরি আসতো। কিছু নির্দেশনা সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকীর পক্ষ থেকেও পৌঁছাতো। আমি আইজিপি থাকলেও সব বিষয়ে অবগত থাকতাম না।”

তিনি আরও বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই র‌্যাবের কর্মকাণ্ড পুলিশের চেইন অব কমান্ডের বাইরে গিয়েছিল এবং এসব কাজ হতো সরাসরি উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নির্দেশনায়।”

গুম ও নির্যাতনের পেছনের প্রক্রিয়া

জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, কাউকে তুলে আনা বা গুম করার মতো সংবেদনশীল কাজগুলো সাধারণত গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি সম্পন্ন হতো এবং এসবের নির্দেশ দিতেন সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকী। “এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলো আইজিপি হয়েও আমাকে জানানো হতো না,” বলেন তিনি।

ব্যারিস্টার আরমানকে দীর্ঘদিন গুম করে রাখার ঘটনাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করে তিনি জানান, “আরমানকে আমার সময়ে নয়, আগের র‌্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদের সময় আটক করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আমি জানলেও কোনো উদ্যোগ নিতে পারিনি।”

নির্যাতন ও ক্রসফায়ার নিয়ে স্বীকারোক্তি

চৌধুরী মামুন স্বীকার করেন, “র‌্যাবের ডিজি থাকার সময় টিএফআই সেলে গুম, নির্যাতন কিংবা ক্রসফায়ারের ঘটনা সম্পর্কে আংশিক জানতাম। তবে আমি কখনো তদন্ত করিনি, কারণ এসব সিদ্ধান্ত অন্য বাহিনী বা উচ্চ পর্যায় থেকে আসতো। পুলিশ প্রধান হয়েও এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না।”

তিনি আরও বলেন, র‌্যাবের অভ্যন্তরে কিছু কর্মকর্তা বিশেষভাবে নির্যাতন ও গুমে দক্ষতার কারণে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নামও উঠে আসে।

নির্বাচনে অনিয়মের প্রসঙ্গ

জবানবন্দিতে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক আইজিপি জানান, “ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখার পরিকল্পনা হয়েছিল এবং পরে সরকারি নির্দেশনায় মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়িত হয়।” তিনি দাবি করেন, ডিসি, ইউএনও, এসিল্যান্ডসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের এই কাজে যুক্ত করা হয়েছিল।

র‌্যাব কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ

চৌধুরী মামুন র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স শাখার তিন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন—সারওয়ার বিন কাশেম, খায়রুল ইসলাম ও মশিউর রহমান। তার মতে, এসব কর্মকর্তা তার দায়িত্বকালীন সময়ে টিএফআই সেলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং অনেক সময় তারা সরাসরি উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মেনে কাজ করতেন।

এছাড়া, আলেপ উদ্দিন নামে এক কর্মকর্তার কথা উল্লেখ করে মামুন বলেন, গুম ও নির্যাতনের কাজে দক্ষতার জন্য তাকে বিশেষভাবে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরের দ্বন্দ্ব

তিনি বলেন, ঢাকায় কর্মরত পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই গোপালগঞ্জের ছিলেন এবং তারা নিজেদের প্রভাব খাটাতেন। এডিশনাল আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমানের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ও তিনি তুলে ধরেন। তাদের ব্যক্তিগত গ্রুপিংয়ের কারণে অনেক সময় শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জটিলতা তৈরি হতো বলে মামুন উল্লেখ করেন।

মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া

সাবেক আইজিপির এই জবানবন্দি প্রকাশের পর দেশের রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এসব স্বীকারোক্তি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

একজন মানবাধিকার বিশ্লেষক বলেন, “যদি আদালতে দেওয়া এই বক্তব্যগুলো সত্য হয়, তবে এটি বাংলাদেশের আইনের শাসন, জবাবদিহি এবং মানবাধিকারের জন্য এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।”

সারসংক্ষেপ  

চৌধুরী মামুনের এই স্বীকারোক্তি দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে বহু প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালত এই বিষয়গুলোর সঠিক তদন্ত করলে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে। তবে এই জবানবন্দি কতটা সত্য এবং এর ভিত্তিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এম আর এম – ০৬০৯ , Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button