উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: ছোটাছুটি শেষ, এবার ওদের অনন্ত ছুটি

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারায় অসংখ্য শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ আরও অনেকে। শিশুদের হাসি থেমে গেছে, তারা পা রেখেছে এক অনন্ত ছুটির পথে।
একটি যুদ্ধবিমান ও একটি স্কুলের মিলন
২১ জুলাই, দুপুরের সময়টা ছিল অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক। ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস চলছিল। হঠাৎ করেই আকাশ থেকে ভেঙে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান, বিধ্বস্ত হয় স্কুল ভবনের ওপর। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় অসংখ্য প্রাণ, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশুশিক্ষার্থী।
ঘটনার পরই জানানো হয়, কমপক্ষে ৩২ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৮ জনই শিশু। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আরও অনেককে। আগুনে দগ্ধ, পোড়া শরীর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে।
শিশুদের চোখে দেখা ছিল স্বপ্ন, ফিরল না তারা
সেদিন সকালে শিশুরা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে এসেছিল। কেউ টিফিন বক্সে মায়ের হাতে বানানো খাবার এনেছিল, কেউ সোনালি কাগজে জড়িয়ে রাখা আঁকাবাঁকা হাতের লেখা হোমওয়ার্ক। স্কুল ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠলে ফেরার কথা ছিল মা-বাবার কোলে, কিন্তু সেদিন তারা ফিরে গেল না। ফিরে গেল অন্য এক জগতে, যেখানে অনন্ত ছুটির কোনো শেষ নেই।
এক শিশুকে দেখা গেছে পোড়া পায়ে স্কুল জুতা পরে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াতে। তার আর্তনাদ শুনে কেঁপে উঠেছে হাজারো হৃদয়। কেউ তাকে সাহায্য করতে পারেনি সময়মতো, আগুন তাকে গ্রাস করে নিয়েছে।
স্কুল নয়, যেন যুদ্ধক্ষেত্র
ঘটনাস্থলের দৃশ্য ছিল বিভীষিকাময়। স্কুল ভবনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পোড়া খাতা, ভেঙে যাওয়া ডেস্ক, টিফিনের পাত্র, ফুটে যাওয়া পানির বোতল। যুদ্ধবিমানটির জ্বালানির আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে পুরো স্কুল বিল্ডিংটি মুহূর্তের মধ্যে রূপ নেয় ধ্বংসস্তূপে।
বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিমানের কারিগরি ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তবে স্বজনহারা পরিবারগুলোর কাছে এসব এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
মা হারায় সন্তান, সন্তান হারায় মা
এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন স্কুলের এক সাহসী শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী, যিনি শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন। তার স্বামী বলেন, “আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না?” উত্তরে মাহরীন বলেছিলেন, “ওরাও তো আমার সন্তান, আমি তাদের একা রেখে চলে আসতে পারি না।”
শুধু মাহরীন নয়, ঘটনাস্থলে অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের খুঁজতে গিয়ে আহত হয়েছেন। কেউ কেউ জানেন না তাদের সন্তান জীবিত, না নিখোঁজ। হাসপাতালের বেডে কাঁদতে থাকা একটি শিশুর মুখেও লেখা ছিল ভয়, আশাহীনতা ও একাকিত্ব।
কতটা প্রস্তুত আমাদের শহর?
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধবিমান পরিচালনা কতটা নিরাপদ? কীভাবে শহরের মধ্যে এমন প্রশিক্ষণ বা উড়োজাহাজ পরিচালনা করা হয় যেখানে স্কুল, আবাসিক এলাকা এবং হাসপাতাল রয়েছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে, যদি এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।
স্মৃতি থেকে যাবে পোড়া বই, ছুটির আবেদন
ঘটনার পরের দিন ক্যাম্পাসে পড়ে ছিল আধপোড়া বই, ছেঁড়া ব্যাগ, আর একটি ছুটির আবেদনপত্র—লিখেছিল তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মেহরিমা জাহান রূপন্তি। জানা যায়নি তার সেই ছুটি অনুমোদিত হয়েছিল কি না, তবে বাস্তবে সেই ছুটি আজীবনের জন্য মঞ্জুর হয়ে গেছে। এই শিশুদের আর কোনো দিন স্কুল ইউনিফর্ম পরে দেখা যাবে না, তারা চলে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখানে কোনো সিলেবাস নেই, নেই সময় বেঁধে দেওয়া পরীক্ষা।
কিছু ছুটি চিরতরেই থেকে যায়
এই ঘটনার পর বহু পরিবার হারিয়েছে সন্তান, স্কুল হারিয়েছে শিক্ষার্থী, জাতি হারিয়েছে ভবিষ্যৎ। এই শোক সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। এই স্মৃতি শুধু মাইলস্টোন স্কুলের নয়, পুরো জাতির হৃদয়ে গেঁথে থাকবে অনন্ত সময়।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই শিশুদের মৃত্যু যদি আমাদের আরও একবার ভাবায়, সচেতন করে, তাহলে অন্তত তাদের ছুটির যাত্রাটা অর্থবহ হবে কি না?
এম আর এম – ০৪৯৪ , Signalbd.com