স্ত্রীকে ১১ টুকরো করে হত্যা, অবশেষে গ্রেফতার হলেন স্বামী সুমন

চট্টগ্রামের পাহাড়িকা হাউজিং সোসাইটিতে ঘটে ভয়াবহ এক হত্যাকাণ্ড। স্ত্রীকে ১১ টুকরো করে লাশ গুমের চেষ্টা করে পলায়ন করেছিলেন স্বামী। মাত্র ৪২ ঘণ্টার মধ্যে র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে খুনি সুমন।
স্ত্রীকে কুপিয়ে ১১ টুকরো করেন স্বামী
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার রৌফাবাদ এলাকায় ঘটে এক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড। স্থানীয় পাহাড়িকা হাউজিং সোসাইটির একটি ভাড়াবাসায় স্ত্রী ফাতেমা বেগম পলিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন তার স্বামী মো. সুমন।
ঘটনাটি ঘটে ৯ জুলাই রাতে। পরে ঘটনার তদন্তে নেমে জানা যায়, স্ত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে লাশ ১১ টুকরো করেন সুমন।
সুমনের পাশবিকতা এখানেই থেমে থাকেনি। নিহতের মাথা ও দুই হাত ফ্রিজে লুকিয়ে রাখেন তিনি। শরীরের বাকি অংশ বাসার বিভিন্ন স্থানে, এমনকি কমোডেও লুকাতে চেয়েছিলেন তিনি।
কীভাবে ফাঁস হলো হত্যাকাণ্ড?
বাসার সিকিউরিটি গার্ড মশিউর রহমান দুর্গন্ধ এবং অস্বাভাবিক শব্দ পেয়ে সন্দেহ করেন। তিনি দরজায় কড়া নাড়লে সুমন তাকে বাধা দেন। কিন্তু সন্দেহ হলে জোর করে বাসায় প্রবেশ করেন মশিউর।
সেখানে তিনি রক্তাক্ত কাপড়, বাথরুমে রক্তের দাগ এবং ঘরের বিভিন্ন জায়গায় অস্বাভাবিক অবস্থা দেখতে পান।
র্যাবের অভিযান ও গ্রেফতার
ঘটনার পরপরই র্যাব-৭, র্যাব সদর দপ্তর এবং র্যাব-৯ (সিলেট) যৌথ অভিযান শুরু করে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অবশেষে ১১ জুলাই রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ফুলবাড়িয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় সুমনকে।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান জানান, সুমন পালিয়ে সিলেটসহ একাধিক জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন। গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি আত্মহত্যার নাটক সাজাতে চাইলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে—পরকীয়ার জেরেই এই হত্যা।
হত্যার পেছনের কারণ: পরকীয়া ও দাম্পত্য কলহ?
জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে ফাতেমার সঙ্গে তার বিয়ে হয় ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী। বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর বিদেশে ছিলেন সুমন। দেশে ফিরে আসার পর থেকে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়।
সুমন দাবি করেন, ঘটনার দিন রাতে বাসায় কয়েকজন অচেনা যুবক আসা নিয়ে ফাতেমার সঙ্গে তর্ক শুরু হয়। এক পর্যায়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ফাতেমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।
শিশুসন্তানকে আগেই সরিয়ে দিয়েছিলেন সুমন
এই দম্পতির আট বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। মর্মান্তিক বিষয় হলো, হত্যাকাণ্ডের আগেই সুমন পরিকল্পিতভাবে তার সন্তানকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন।
পুলিশ ও র্যাব ধারণা করছে, সুমনের মাথায় আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল স্ত্রীকে খুন করার।
প্রতিবেশীদের ভূমিকা ও পুলিশের অভিযান
প্রতিবেশীদের দ্রুত সাড়া ও সিকিউরিটির তৎপরতায় ঘটনা দ্রুত জানাজানি হয়ে যায়। এরপর বায়েজিদ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাসার ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফাতেমার খণ্ডিত দেহ উদ্ধার করে।
নিহতের ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল বাদী হয়ে বায়েজিদ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডে চট্টগ্রামজুড়ে চাঞ্চল্য
এই ঘটনার পর চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে চলছে আলোচনা, শোক আর নিন্দার ঝড়।
মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই হত্যাকাণ্ড।
সম্পর্কের টানাপোড়েন কি এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য কলহ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে কাউন্সেলিং বা পারিবারিক মধ্যস্থতার ব্যবস্থা থাকা উচিত। কারণ, এমন ঘটনা শুধু দুটি জীবন নয়, একটি পরিবার, একটি সমাজ, এমনকি একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
“ঘাতক সুমনের পরিকল্পনা ছিল ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে সব প্রমাণ লুকিয়ে ফেলা। কিন্তু প্রযুক্তি ও জনগণের সহযোগিতায় আমরা ৪২ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে গ্রেফতার করতে পেরেছি”—র্যাব-৭ অধিনায়ক কর্নেল হাফিজুর রহমান।
পাহাড়িকা হাউজিংয়ের এই নির্মম হত্যাকাণ্ড নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—পারিবারিক সম্পর্কের অবনতির পরিণাম কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে?
অপরাধী যত চালাকই হোক না কেন, আইনের হাত থেকে কেউ রেহাই পায় না—সেটাই আবার প্রমাণিত হলো এই ঘটনায়।
এম আর এম – ০২৯৫, Signalbd.com