জাপান আবারও প্রযুক্তি জগতে নতুন অধ্যায় লিখেছে। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশনস টেকনোলজি (এনআইসিটি) সম্প্রতি একটি অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করেছে। পরীক্ষামূলকভাবে তারা প্রতি সেকেন্ডে ১.৮৬ এক্সাবিট (Exabit) তথ্য স্থানান্তর করার গতি অর্জন করেছে, যা বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট গতি সংক্রান্ত সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
এই গতি কতটা বিস্ময়কর? শুধু মাত্র এক সেকেন্ডে এই গতিতে ডেটা পাঠাতে পারলে আপনি সহজেই ডাউনলোড করতে পারবেন পুরো নেটফ্লিক্স লাইব্রেরি বা হাজার হাজার বার ইংরেজি উইকিপিডিয়ার বিশাল তথ্যভান্ডার। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, এটি মানব ইতিহাসে ইন্টারনেট সংযোগের সর্বোচ্চ গতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কিভাবে করা হলো এই অসাধারণ সফলতা?
এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে এনআইসিটির ফটোনিক নেটওয়ার্ক ল্যাবরেটরির নেতৃত্বে। এতে অংশ নিয়েছে জাপানের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সুমিতোমো ইলেকট্রিক এবং ইউরোপের কয়েকটি প্রধান গবেষণাগার। পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে একটি ১৯ কোরবিশিষ্ট বিশেষ অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল, যার ব্যাস মাত্র ০.১২৫ মিলিমিটার — প্রচলিত ফাইবার কেব্লের মতোই দেখতে।
গবেষকরা ৮৬.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফাইবার লুপ তৈরি করেছেন, যা মোট ২১ বার পুনরাবৃত্তি করে ১,৮০৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বিশেষ লাইন তৈরি হয়। এই লুপের মাধ্যমে ১৯টি পৃথক কোরে ১৮০টি স্বতন্ত্র তথ্যপ্রবাহ একযোগে পাঠানো সম্ভব হয়। এর ফলে প্রতি কিলোমিটারে প্রতি সেকেন্ডে ১.৮৬ এক্সাবিট ডেটা স্থানান্তরের গতি রেকর্ড হয়।
প্রযুক্তির বিশদ বিবরণ
এই কেব্ল তৈরি করেছে সুমিতোমো ইলেকট্রিক, এবং এনআইসিটি ডিজাইন করেছে উন্নত মানের ট্রান্সমিটার, রিসিভারসহ অন্যান্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উপকরণ। এনআইসিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রমাণ করতে চেয়েছি, বর্তমান অবকাঠামো ব্যবহার করেই দীর্ঘ দূরত্বে আলট্রা–হাই স্পিড ইন্টারনেট সংযোগ সম্ভব। এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।’
এই পরীক্ষায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি কেবল কোর সংখ্যা বাড়িয়ে গতি বৃদ্ধি করেছে না, বরং তথ্যের নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করেছে। এটি বর্তমান ফাইবার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই সহজেই পুরনো অবকাঠামোতে একে সংযুক্ত করা সম্ভব।
গতি ও ব্যবহারের ভবিষ্যত প্রভাব
তথ্যপ্রযুক্তি ওয়েবসাইট গ্যাজেট-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই গতি দিয়ে এক সেকেন্ডে ডাউনলোড করা সম্ভব ইংরেজি উইকিপিডিয়ার প্রায় ১০০ গিগাবাইট তথ্য এক লাখবার! একই সময়ে উচ্চ রেজোলিউশনের ৮কে ভিডিও ফাইল ডাউনলোড করা সম্ভব, যা ভিডিও স্ট্রিমিং এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR) প্রযুক্তির উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাবে।
বিশ্বজুড়ে ভিডিও স্ট্রিমিং, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলে ডেটা ব্যবহারের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এজন্য দ্রুত, নির্ভরযোগ্য এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগের চাহিদাও বেড়েই চলেছে। জাপানের এই অর্জন বিশ্বকে দেখিয়েছে, কেবল অবকাঠামো পরিবর্তন ছাড়াই উচ্চ গতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করা সম্ভব।
তবে সাধারণ মানুষের জন্য এই প্রযুক্তি কবে থেকে বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ হবে, সেই বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চিত তথ্য জানায়নি এনআইসিটি।
জাপানের প্রযুক্তি অগ্রগতি ও ভবিষ্যত দিক
জাপান দীর্ঘদিন ধরেই প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশের অবদান অনেক আগেই স্বীকৃত। এই নতুন গতি রেকর্ড জাপানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার একটি অন্য মাত্রা যোগ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের প্রযুক্তিগত উন্নতি বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট পরিষেবার মান উন্নত করবে, বিশেষ করে দূরবর্তী ও গ্রামীণ অঞ্চলে দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে ডিজিটাল সুবিধা বাড়বে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এখনই ফাইবার অপটিক প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণ নিয়ে গবেষণা করছে। জাপানের এই সাফল্য আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতায় নতুন দিক নির্দেশ করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটাও একটি প্রেরণা যে, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে গতি বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়নে এই ধরনের গবেষণার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয়। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা চালু করতে চাইলে আধুনিক ফাইবার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি কোর প্রযুক্তির উন্নয়নেও জোর দেওয়া প্রয়োজন।
জাপানের এই অভূতপূর্ব গবেষণা প্রযুক্তি জগতের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। এটি প্রমাণ করে, বিদ্যমান অবকাঠামোকে আধুনিকায়ন করে দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ তৈরি সম্ভব। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হলে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল যোগাযোগ, অনলাইন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বিনোদন শিল্পে এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
জাপানের এই সফলতা আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সম্প্রদায়ের জন্য এক নতুন মাইলফলক। এটি শুধু একটি রেকর্ড নয়, বরং ভবিষ্যতের ইন্টারনেটের গতি এবং ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি।



