বাংলাদেশ

সাবেক সচিব-নির্বাচন কমিশনারসহ ১২ জনের ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল

Advertisement

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্মাণাধীন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ১২টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বাতিল করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। বাতিলকৃত ফ্ল্যাটের তালিকায় রয়েছেন সাবেক সচিব, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, এবং একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারও।

কারা পড়লেন বরাদ্দ বাতিলের তালিকায়?

মঙ্গলবার (৮ জুলাই) মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘গৃহায়ন ধানমন্ডি (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়া ফ্ল্যাটগুলোর বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে।

এই প্রকল্পটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন, যার আওতায় ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সড়ক নং-১৩ (নতুন ৬/এ), বাড়ি নং-৭১১ (নতুন ৬৩)-এ নির্মাণাধীন ভবনে ফ্ল্যাটগুলো অবস্থিত ছিল।

এগুলো বরাদ্দ পেয়েছিলেন মূলত সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও বিচারকরা। বরাদ্দ বাতিল হওয়া ১২ জনের তালিকায় রয়েছেন:

  1. মো. জহুরুল হক – অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও সাবেক দুর্নীতি দমন কমিশনার (৪১০৫.০৫ বর্গফুট)
  2. মো. ইউনুসুর রহমান – সাবেক সিনিয়র সচিব (২৩১৫.৮৩ বর্গফুট)
  3. ড. মো. মোজাম্মেল হক খান – সাবেক সচিব ও দুদক কমিশনার (৪৩০৮.৬৮ বর্গফুট)
  4. এম এ কাদের সরকার – সাবেক সচিব (২০৪৯.১৩ বর্গফুট)
  5. ড. এম আসলাম আলম – সাবেক সিনিয়র সচিব (২০৪৯.১৩ বর্গফুট)
  6. আকতারী মমতাজ – সাবেক সচিব (২০৪৯.১৩ বর্গফুট)
  7. মো. সিরাজুল হক খান – সাবেক সচিব (২৩১৫.৮৩ বর্গফুট)
  8. মো. মঞ্জুরুল বাছিদ – অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ (২৩১৫.৮৩ বর্গফুট)
  9. সৈয়দ আমিনুল ইসলাম – সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সিনিয়র জেলা জজ (২০৪৯.১৩ বর্গফুট)
  10. অধ্যাপক নেহাল আহমেদ – মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (২০৪৯.১৩ বর্গফুট)
  11. মো. আনিছুর রহমান – সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সিনিয়র সচিব (২৩১৫.৮৩ বর্গফুট)
  12. এস. এম. গোলাম ফারুক – সাবেক সিনিয়র সচিব (২০৪৯.১৩ বর্গফুট)

তদন্ত প্রতিবেদন ও বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত

সূত্র জানায়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের গঠিত একটি কমিটি এই ফ্ল্যাট বরাদ্দের বৈধতা নিয়ে তদন্ত করে। তদন্ত প্রতিবেদনে একাধিক অনিয়ম এবং বিধিবহির্ভূত বরাদ্দ চিহ্নিত করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ২৭৪তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়—এই বরাদ্দ বাতিল করতে হবে। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এই বরাদ্দগুলো বাতিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়।

বরাদ্দ বাতিলের পেছনে সম্ভাব্য কারণ কী?

অফিশিয়াল বিবৃতিতে বরাদ্দ বাতিলের নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ না করা হলেও, বিভিন্ন প্রশাসনিক সূত্র বলছে—বরাদ্দপ্রাপ্তরা সক্রিয় সরকারি কর্মকর্তা নন। অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত। আর এই প্রকল্প মূলত কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রণীত।

সেই প্রেক্ষাপটে সাবেক বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বরাদ্দ কিছুটা অনিয়মের পর্যায়ে পড়ে, যা নিয়ে আগেই বিতর্ক চলছিল প্রশাসনিক মহলে।

বিশ্লেষকরা কী বলছেন?

জনপ্রশাসন বিশ্লেষক এবং নগর উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের মতে, “সরকারি আবাসন প্রকল্পের স্বচ্ছতা রক্ষা করতে হলে বরাদ্দ প্রক্রিয়া কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শুধু প্রভাবশালী পরিচয়ের ভিত্তিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দের সুযোগ থাকলে সেটি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।”

একজন সিনিয়র সিটি প্ল্যানার বলেন, “আবাসিক প্রকল্পগুলোতে নীতিমালা প্রয়োগে পক্ষপাতিত্ব দেখা গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প জনপ্রিয়তা হারাবে। বরাদ্দ বাতিল একটি সাহসী পদক্ষেপ, তবে আরও তদন্ত হওয়া উচিত—এই বরাদ্দ কীভাবে এবং কার অনুমোদনে হয়েছিল।”

আর্থিক দিক থেকে কী প্রভাব পড়বে?

এই প্রকল্পটি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন হওয়ায়, বাতিল হওয়া বরাদ্দগুলোর কারণে নতুন করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ ও বিক্রির মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি এই বরাদ্দগুলো নতুন করে নীতিমালার আলোকে যাচাই করে কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, তবে সেটি প্রকল্পের কার্যকারিতা বাড়াবে এবং আস্থা ফিরিয়ে আনবে।

পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাতিল হওয়া ফ্ল্যাটগুলো নতুন করে বরাদ্দের আগে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হবে। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে এ ধরনের বিতর্ক এড়াতে বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল যাচাই চালু করা হবে।

তবে এখনও বাতিলকৃত বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে আইনি সহায়তা নেওয়ার কথা ভাবছেন বলেও জানা গেছে।

সারসংক্ষেপ

গৃহায়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাবেক সচিব ও কমিশনারদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত সরকারি নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ফেরানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এই ধরনের বরাদ্দ কীভাবে অনুমোদিত হয়েছিল, সেই প্রশ্নের জবাব এখনও অমীমাংসিত।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়—আবাসন বরাদ্দ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আদৌ কি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, না কি এটি কেবল একটি লোক দেখানো সিদ্ধান্ত?

এম আর এম – ০২২৯, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button