মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ : আতঙ্কে সাধারণ জনতা

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মব সন্ত্রাস উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ছোটখাটো অভিযোগে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জনতার হাতে তুলে দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা বা মারধরের ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এর মূল কারণ।
ঘটনার বিস্তারিত চিত্র
গত এক বছরে গণপিটুনির ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। সম্প্রতি কুমিল্লা, গাজীপুর, লালমনিরহাট, চট্টগ্রাম, ঢাকা—প্রায় সব জেলাতেই একই ধরনের নৃশংসতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিজেরাই ‘বিচারক’ হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সীমাবদ্ধতা ও অনুপস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম হয়। খলিলুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), ছেলে রাসেল মিয়া (৩৮) ও মেয়ে জোনাকী আক্তার (৩২) – এই তিনজনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মোবাইল চুরির সন্দেহে স্থানীয় লোকজন তাদের উপর হামলা চালায়। অথচ কোনো আদালতে অভিযোগ তোলা হয়নি, কোনো প্রমাণ ছিল না।
গাজীপুরের কোনাবাড়ীতেও ১৯ বছরের যুবক হৃদয় একই পরিণতির শিকার হন। তাঁকে চুরির অভিযোগে রশি দিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে মারা হয়। একই রকম ঘটনা লালমনিরহাটে, চট্টগ্রামে, এমনকি রাজধানীতেও ঘটেছে সম্প্রতি।
বেড়ে চলা মব সন্ত্রাস
গণপিটুনি বা মব সন্ত্রাস নতুন নয়, তবে বিগত কয়েক বছর ধরে এটির মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ২৫৩টি মব সন্ত্রাসের ঘটনায় ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হয়েছেন (মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী)।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর মতে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৭৮ জন। এমন পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় অগ্রহণযোগ্য।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, সাধারণ মানুষ সবাই আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ। বিএনপি স্পষ্টভাবে বলেছে, মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধের বিচার হবে আদালতে, রাস্তায় নয়।
বাম গণতান্ত্রিক জোটও সরকারের নীরব ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, বারবার এমন ঘটনা ঘটলেও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ
মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলছে, শুধু জুন মাসেই অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
ডাকাতি, চুরি, ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ – এসব অভিযোগে ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বিচার হয়নি বা সত্যতা যাচাই করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক প্রশ্রয়, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং সামাজিক অসহিষ্ণুতাই মব সন্ত্রাসের মূল উৎস।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “মব সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না, কারণ যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা গৃহীত হচ্ছে না। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এর সমাধান হবে না।”
পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম জানান, “মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। তবে পুলিশের একার পক্ষে এটি সম্ভব নয়। সমাজের সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন।”
“অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। জনগণকে সচেতন হতে হবে। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে পুলিশে সোপর্দ করুন”—পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম।
সারসংক্ষেপ
মব সন্ত্রাস কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি দেশের আইন ও মানবাধিকার ব্যবস্থার ওপর এক বিশাল আঘাত। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত ও কার্যকর আইনি পদক্ষেপ, জনসচেতনতা এবং বিচার ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। নইলে ‘সন্দেহ’ নামক অস্ত্রে প্রতিদিনই প্রাণ হারাবে নিরপরাধ মানুষ, এবং দেশ এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাবে।
এম আর এম – ০১৭৬, Signalbd.com