চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১০ কোটি টাকার এমআরআই ৩.৫ কোটিতে মেরামত

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্র সাড়ে ৩ কোটি টাকায় মেরামত, তিন বছর পর আবার চালু
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অত্যাধুনিক ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (MRI) যন্ত্রটি প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক মেরামত ও প্রযুক্তিগত কাজের জন্য মোট খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
যন্ত্রটির প্রাথমিক মূল্য ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকা, যা দেশে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল চিকিৎসা যন্ত্র। মেরামতের পর বর্তমানে এটি এক বছরের ওয়ারেন্টির আওতায় রয়েছে, যার মাধ্যমে যন্ত্রের যেকোনো ত্রুটি সহজে ঠিক করা সম্ভব হবে।
এমআরআই যন্ত্রের ইতিহাস ও সমস্যাসমূহ
২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট চমেক হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে এই এমআরআই যন্ত্রটি বসানো হয়েছিল। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ছিল ‘মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড’। যন্ত্রটির আনুমানিক মূল্য ছিল ৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
তিন বছরের ওয়ারেন্টি মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের আগস্টে। এরপর ২০২১ সালের মে মাসে যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে ২০২২ সালের মে মাসে পুরোপুরি অকার্যকর হয়। এর ফলে রোগীরা জরুরি এমআরআই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন।
মেরামত ও পুনঃচালুর প্রক্রিয়া
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চমেক কর্তৃপক্ষ পুনরায় মেডিটেলকে মেরামতের দায়িত্ব দেয়। চট্টগ্রাম শাখার প্রধান প্রকৌশলী শফিক আহমেদ জানান, ‘আমরা যন্ত্রটি সম্পূর্ণ মেরামত করেছি এবং এখন এটি এক বছরের ওয়ারেন্টির আওতায় রয়েছে। যেকোনো যান্ত্রিক সমস্যা ধরা পড়লে আমরা তা দ্রুত সমাধান করবো।’
মেরামতের পর জুন মাস থেকে পরীক্ষা শুরু হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যন্ত্রটি গ্রহণ করেনি। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত গড়ে ৫টি এমআরআই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
যন্ত্রটির ব্যবহার ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
চমেক হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক কাজী আলম জানিয়েছেন, ‘যন্ত্রটি এখনও পুরোনো, আর টেকনোলজিস্টের সংকট রয়েছে। এজন্য দিনে চার থেকে পাঁচটির বেশি পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। একটি এমআরআই পরীক্ষায় প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে।’
এর আগে, এমআরআই যন্ত্র চালু থাকাকালে দিনে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি পরীক্ষা করা হতো। কিন্তু এখন এর সক্ষমতা কম।
এমআরআই পরীক্ষার খরচ ও রোগীদের সুবিধা
সরকার নির্ধারিত মূল্যে চমেক হাসপাতালে এমআরআই পরীক্ষা করাতে খরচ পড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা, যা দেশের বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। বেসরকারি হাসপাতালে এই খরচ ৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
নিউরোলজি বিভাগে ভর্তি রোগী রবিউল হোসেন জানিয়েছেন, ‘বাইরে যেখানে ১০ হাজার টাকা দিতে হত, এখানে মাত্র ৩ হাজার টাকায় পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেন্ট্রাল মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট (সিএমসি) ও প্রয়োজনীয়তা
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসা যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিএমসি (Central Maintenance Contract) চালুর নির্দেশনা দেয়। এর আওতায় যন্ত্রের মূল্যের ওপর নির্ভর করে বার্ষিক ৬.৫ শতাংশ খরচ ধরে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
তবে চমেক হাসপাতাল এখনো এই যন্ত্রটির জন্য সিএমসি কার্যকর করেনি, যা যন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য জরুরি।
হাসপাতালের অবস্থা ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা বর্তমানে ২ হাজার ২২টি। এমআরআই সেবা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে রোগীদের বিশাল চাপ তৈরি হয়েছিল। মেরামতের পর যন্ত্রটি চালু হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে।
হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন জানিয়েছেন, ‘দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যন্ত্রটি চালু হওয়ায় রোগীরা অনেকটা সুবিধা পাচ্ছে। এক বছরের ওয়ারেন্টি থাকায় যন্ত্রের সেবা নিশ্চিত। ভবিষ্যতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিএমসি চুক্তি করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
এমআরআই প্রযুক্তির গুরুত্ব ও রোগীদের জন্য সুবিধা
এমআরআই পরীক্ষা হলো একটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক ছবি দেয়। বিশেষ করে মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড, জয়েন্ট ও নরম টিস্যুগত সমস্যাগুলো নির্ণয়ে এমআরআই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি হাসপাতালে এই পরীক্ষার সুলভ দাম এবং যন্ত্রের সচলতা রোগীদের জন্য এক বিরাট সহায়তা। ফলে তারা বাড়তি খরচ না করে উন্নত মানের সেবা গ্রহণ করতে পারছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্রের মেরামত এবং পুনরায় চালু হওয়া স্বাস্থ্যসেবায় একটি বড় সাফল্য। যন্ত্রটির উন্নত সেবা চালু থাকলে, রোগ নির্ণয়ে সময় কম লাগবে এবং রোগীদের অর্থনৈতিক বোঝা কমবে।
ভবিষ্যতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে চমেক হাসপাতাল দেশের অন্যতম শীর্ষ হাসপাতালের মর্যাদা বজায় রাখতে পারবে।