বাংলাদেশে জাপানের সহযোগিতা আরও বাড়াতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপানের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে সহযোগিতা আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে বিনিয়োগ, মৎস্যসম্পদ, রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ মানবিক সহায়তা এবং যুব উন্নয়ন—শিক্ষা ও খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে এগিয়ে নিতে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান তিনি।
এই আহ্বান তিনি দিয়েছেন ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) নির্বাহী সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়াজাকি কাতসুরার সঙ্গে এক বৈঠকে।
বাংলাদেশ ও জাপানের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায়
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “জাপান সব সময়ই বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু। আমি সম্প্রতি জাপান সফর করেছি এবং সেখানে আমার ও আমার প্রতিনিধিদলের প্রতি যেভাবে আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা প্রদর্শিত হয়েছে, তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।”
মিয়াজাকি কাতসুরা বলেন, “এশিয়ায় বাংলাদেশ আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
মৎস্য, বিনিয়োগ ও রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার গুরুত্ব
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মাতারবাড়ী প্রকল্পের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেন। তিনি এটিকে ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল’ হিসেবে অভিহিত করেন। মাতারবাড়ী তেল-গ্যাস ক্ষেত্র এবং সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, “আমি জাপানে জাইকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাকে জানিয়েছি, বাংলাদেশ একটি সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হতে চায়। এ জন্য আমাদের সামুদ্রিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন।”
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “হাজার হাজার তরুণ ক্যাম্পে বড় হচ্ছে, যারা ভবিষ্যতের কোনো আশা ছাড়াই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। তাদের জন্য প্রয়োজন মানবিক সহায়তা ও সঠিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ।”
যুব উন্নয়ন ও শিক্ষায় জাপানের সহযোগিতার আহ্বান
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য জাপানে পড়াশোনার বৃত্তি বাড়ানো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণেরও প্রস্তাব দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “অনেক তরুণ জাপানে কাজ করতে যেতে চায়, তবে ভাষার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, জাপানি ভাষা ও কর্মস্থলের শিষ্টাচার শেখানোর জন্য জাপানি শিক্ষকদের বাংলাদেশে পাঠানো হোক বা দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।”
নারীদের খেলাধুলায় সাফল্য ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
যুব উন্নয়নে নারীদের অবদান তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মেয়েরা খেলাধুলায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করছে। গতকাল তারা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জয়ী হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছে। আমরা হোস্টেল সুবিধা বাড়াচ্ছি, কিন্তু স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণের জন্য আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।”
মিয়াজাকি জানান, “জাপান ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবক পাঠাচ্ছে। নারীদের খেলাধুলায় আরও সহযোগিতার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবো।”
অর্থনৈতিক সংস্কার, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা
অধ্যাপক ইউনূস জাপানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “অর্থনৈতিক সংস্কার, রেলপথ নির্মাণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য জাপান এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ ও অনুদান প্রদান করেছে। আমরা আশা করি, বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার (ওডিএ) সীমা ৩০০ বিলিয়ন ইয়েন থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ইয়েনে বাড়ানো হবে, যা আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে আরও গতিশীল করবে।”
আইসিটি ও প্রযুক্তিতে জাইকার নতুন উদ্যোগ
মিয়াজাকি জানান, “২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জাইকা বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার এবং উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে। এছাড়া, আইসিটি মানবসম্পদবিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সরকার, কোম্পানি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হবে।”
ভবিষ্যতের জন্য সুদৃঢ় অংশীদারিত্ব
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শেষ কথায় বলেন, “বাংলাদেশ সব সময় জাপানের বন্ধুত্ব ও অবদানের কথা মনে রাখবে। আমরা চাই, এই সহযোগিতা নতুন মাত্রায় পৌঁছুক, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।”
সংক্ষেপে:
- প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপানের সঙ্গে বিনিয়োগ, মৎস্য, রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা ও যুব উন্নয়ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন।
- মাতারবাড়ী প্রকল্পকে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
- তরুণদের জন্য জাপানে বৃত্তি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর প্রস্তাব।
- নারীদের খেলাধুলায় সাফল্যের জন্য আরও সমর্থনের দাবি।
- জাপানকে ধন্যবাদ জানিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ওডিএ সীমা বাড়ানোর অনুরোধ।
- জাইকা আইসিটি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা।
বাংলাদেশ ও জাপানের এই অংশীদারিত্ব শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম নয়, বরং দেশের সামাজিক ও মানবিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে।