নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে জরুরি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি

বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতনের হার এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, তা এখন ‘মহামারি’ আকার ধারণ করেছে। এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছেন নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি জানান, মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৪ জন নারী ও শিশু।
তিনি বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতন এখন দেশের জন্য মহামারির মতো একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে মাদক, রাজনীতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার (বিশেষত মোবাইল ও পর্নোগ্রাফি) ইত্যাদি বড় কারণ।”
ধর্মভীরু সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের চরম উদাহরণ
উপদেষ্টা আরও বলেন, “আমরা তো ধর্মভীরু সমাজ। তবুও একটি ষাট বছরের বৃদ্ধ যখন একটি শিশুকে ধর্ষণ করে, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা আদৌ ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করি কি না?”
তিনি বলেন, “আমি মানবাধিকার কর্মী হওয়া সত্ত্বেও এমন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড চাই। এমন পরিস্থিতিতে নরম মনোভাব ধরে রাখা সম্ভব নয়।”
মাদ্রাসায় শিশুদের যৌন নির্যাতন: চাপা বাস্তবতা
মাদ্রাসাসমূহে শিশুদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগও উঠে এসেছে। শারমীন মুরশিদ বলেন, “মাদ্রাসাগুলো অনেক সময় নজরদারির বাইরে থাকে। ফলে এইসব প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, কিন্তু তা সামনে আসে না। তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছায় না।
আমার দাবি, এখন থেকে স্কুল ও মাদ্রাসায় সরাসরি নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যাবেন এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”
পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দেয় ভয়াবহ বাস্তবতার
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৪৫টি নির্যাতনের অভিযোগ। তবে মন্ত্রণালয়ের পর্যাপ্ত জনবল ও সম্পদের অভাবে প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত ও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
“আমরা তাৎক্ষণিক গুরুত্ববহ ঘটনাগুলোর দ্রুত সমাধান করে থাকি। ইতোমধ্যে শতাধিক নারীকে কাউন্সেলিং ও আইনি সহায়তার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে,” বলেন শারমীন মুরশিদ।
সহিংসতা প্রতিরোধে সার্বক্ষণিক কুইক রেসপন্স টিম গঠনের উদ্যোগ
উপদেষ্টা জানান, “দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়েও নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হবে।
অফিসে বসে থেকে এই সমস্যার সমাধান হবে না, মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজ করতে হবে।”
তিনি কুমিল্লার মুরাদনগরে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় ইউএনও-কে প্রধান করে কুইক রেসপন্স টিম কাজ শুরু করেছে বলেও জানান।
“এই ঘটনার দ্রুত বিচার হওয়া উচিত এবং অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
সামাজিক ও পারিবারিক চেতনায় দুর্বলতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারে সঠিক নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা না থাকায় শিশু ও কিশোররা বিপথগামী হচ্ছে।
“অভিভাবকদেরও চোখ বন্ধ করে রাখলে চলবে না। সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে, কী দেখে—সেগুলো নজরে রাখতে হবে,” বলেন সমাজবিজ্ঞানী ডা. নাসিমা আক্তার।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বর্তমানে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) রয়েছে, যা ধর্ষণসহ সকল প্রকার যৌন ও শারীরিক সহিংসতার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে।
কিন্তু বাস্তবে মামলা পরিচালনা, সাক্ষীর অভাব, প্রমাণ সংগ্রহে দুর্বলতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে অনেক সময় ন্যায় বিচার বিঘ্নিত হয়।
পর্নোগ্রাফির ভয়াবহ ছায়া সমাজে
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) একাধিকবার পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট বন্ধ করলেও, প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে সেগুলো আবার চালু হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেট ব্যবহারে শিশুদের যথাযথ পর্যবেক্ষণ জরুরি। মোবাইলে ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ অ্যাপ চালু করা এবং নির্ধারিত সময়ের বাইরে মোবাইল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে।
সমাধানের পথ কী?
১. শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি: শিশুদের আত্মরক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে বিদ্যালয়ে উপযুক্ত যৌন শিক্ষা চালু করা দরকার।
২. পরিবারিক মূল্যবোধ জোরদার: অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারের ভিত শক্ত করতে হবে।
৩. বিচার ব্যবস্থায় গতি আনা: দ্রুত ও কার্যকর বিচার নিশ্চিত করতে হবে যেন অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।
৪. মিডিয়ায় সচেতনতামূলক প্রচারণা: টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউবসহ সব মাধ্যমে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতনতামূলক কনটেন্ট বাড়াতে হবে।
৫. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ: পুলিশ ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নারী ও শিশু বিষয়ক ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা আজ এক গভীর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তি—সকল স্তরে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ ভয়াবহতা থেকে মুক্তি সম্ভব।
শারমীন মুরশিদের মন্তব্য শুধু আতঙ্ক নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা—আর বসে থাকার সময় নেই। এখনই সময় প্রতিরোধ গড়ার।