উচ্চ লবণসহিষ্ণু গম ‘জিএইউ গম ১’ গমের নতুন জাত উদ্ভাবন

দেশের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হলো গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগ উদ্ভাবন করেছে লবণসহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল গমের নতুন জাত ‘জিএইউ গম ১’। এটি বাংলাদেশের কৃষিতে লবণাক্ত মাটিতে সফলভাবে চাষযোগ্য গমের প্রথম জাত হিসেবে পরিচিত হবে।
‘জিএইউ গম ১’ – লবণাক্ত মাটিতে সফল গমের নতুন দৃষ্টান্ত
লবণাক্ততা অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নিকটবর্তী এলাকার কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। অধিক লবণাক্ত মাটিতে ফসল জন্মানো কঠিন হয়ে ওঠে, যা কৃষকদের আয় কমায় ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলে। এই সমস্যা সমাধানে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ময়নুল হক ও মসিউল ইসলামের নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল দীর্ঘদিন কাজ করে গমের একটি বিশেষ জাত উদ্ভাবন করেছেন, যেটি লবণাক্ততা সহ্য করতে সক্ষম।
এই গমের নতুন জাত ‘জিএইউ গম ১’ উচ্চ লবণসহিষ্ণু হওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের নোনা মাটিতে সফলভাবে চাষ করা যাবে। ফলে দেশের ওই অঞ্চলের কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা শক্তিশালী হবে।
বৈশিষ্ট্য ও গবেষণার ফলাফল
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আকব্বাস উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘জিএইউ গম ১’ শুধু লবণসহিষ্ণু নয়, এটি উচ্চফলনশীল এবং প্রোটিনে সমৃদ্ধ। লবণাক্ত মাটিতে এ জাতের গম থেকে হেক্টর প্রতি প্রায় ৩.৭৫ টন ফলন পাওয়া যায়, যা সাধারণ মাটিতে ৪.৫ টনের কাছাকাছি।
অধ্যাপক মসিউল ইসলাম বলেন, “দেশের উপকূলীয় ও লবণাক্ত এলাকার কৃষকদের জন্য এটি এক বিপ্লব। দীর্ঘ গবেষণা ও মাঠপরীক্ষার মাধ্যমে আমরা এই জাত উদ্ভাবন করেছি, যা লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে এবং বেশি ফলন দিতে সক্ষম। কৃষকদের লাভবান করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”
২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এ গমের ফলন ও সহিষ্ণুতা প্রমাণিত হয়। জাতীয় বীজ বোর্ড ১৭ জুন ২০২৫ সালে ‘জিএইউ গম ১’ জাতকে সরকারি অনুমোদন দিয়েছে।
পুষ্টিগুণ ও মানবদেহে উপকারিতা
এই গমের প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এটি মানব শরীরের পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরে প্রোটিন মেরামত ও শক্তি সরবরাহের কাজ করে। এর পাশাপাশি পর্যাপ্ত গ্লুটেনিন থাকার কারণে গমের গুণগত মান উন্নত হয়, যা রুটি ও অন্যান্য খাদ্য তৈরিতে উপযোগী।
কৃষকদের জন্য সুবিধা ও চাষাবাদের সময়কাল
‘জিএইউ গম ১’ গাছের কাণ্ড মোটা ও গুটির সংখ্যা বেশি হওয়ায়, প্রচুর খড় পাওয়া যায় যা গবাদি পশুর খাদ্যের উৎস হতে পারে। আমন মৌসুমে ধান কাটার পর এই গমের বীজ বপন করলে মাত্র ৯৫-১০০ দিনে ফসল সংগ্রহ সম্ভব, যা কৃষকদের জন্য সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ তৈরি করে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত সহিষ্ণুতা
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানাচ্ছেন, ‘জিএইউ গম ১’ শুধু লবণসহিষ্ণু নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম এবং রোগ-পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতাও রয়েছে। এই কারণে দেশের বিভিন্ন পরিবেশ ও মাটিতে চাষের জন্য এটি উপযোগী ও লাভজনক।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে সম্ভাবনা ও গুরুত্ব
বাংলাদেশের কৃষিখাতে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা এখন ৯১-এ পৌঁছেছে। এর মধ্যে ‘জিএইউ গম ১’ জাতটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। লবণাক্ত মাটি যেখানে আগে ফসল উৎপাদনে বাধা ছিল, সেখানে এখন নতুন সম্ভাবনার সূচনা হলো।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ‘জিএইউ গম ১’ জাতের এই অবদান অত্যন্ত মূল্যবান। কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি প্রথায় পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে খাদ্যে।