এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতিসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের দুর্নীতি অনুসন্ধান শুরু

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও। রবিবার (২৯ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানায় সংস্থাটি।
ঘটনা ও অনুসন্ধানের বিস্তারিত
দুদক সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে কর ফাঁকির সুযোগ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং নিজেরাও সম্পদ গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তারা ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন করদাতার সঙ্গে গোপন চুক্তিতে ঘুষের বিনিময়ে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়েছেন।
এই ছয় কর্মকর্তারা হলেন:
- এ কে এম বদিউল আলম (আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য)
- হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার (অতিরিক্ত কমিশনার, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর)
- মির্জা আশিক রানা (অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা কর অঞ্চল-৮)
- মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা (অতিরিক্ত কর কমিশনার, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬)
- সাধন কুমার কুন্ডু (অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট)
- মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান (যুগ্ম কর কমিশনার, বিএসএস কর একাডেমি)
দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হলো—এই অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই এবং প্রয়োজন হলে মামলা দায়ের।
আন্দোলন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
প্রসঙ্গত, এই ছয় কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচজন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সক্রিয় সদস্য। যাদের মধ্যে হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার হচ্ছেন সংগঠনটির সভাপতি। এছাড়াও সহ-সভাপতির পদে আছেন মির্জা আশিক রানা ও মোনালিসা শাহরীন।
গত ১২ মে সরকারের সিদ্ধান্তে এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের পর থেকেই রাজস্ব খাতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। আন্দোলনকারীদের দাবি—নতুন বিভাগে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, প্রশাসন ক্যাডারের নয়।
এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা এবং অনুসন্ধানের খবর অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এটি আন্দোলন দমন করার কৌশলও হতে পারে।
অভিযোগের ধরন
দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা করদাতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণ করেছেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ঘুষ না দিলে মিথ্যা মামলার ভয় দেখানো হতো।
অভিযোগ রয়েছে—কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিতে ঘুষ নেওয়া হতো, আবার করদাতা বেশি কর দিলে তা ফেরত দিতে গেলে ঘুষ না দিলে হয়রানি করা হতো। এইসব পদ্ধতির মাধ্যমে বছরে শত কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না পড়ে, ব্যক্তিগত পকেটে চলে যেত।
অতীতের প্রেক্ষাপট ও আইএমএফের ভূমিকা
রাজস্ব খাতে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের দাবি ছিল অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার একটি শর্তই ছিল রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ।
সরকার সেই সংস্কার বাস্তবায়নে এগোতে চাইলে এনবিআরের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ দেখা দেয়। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, এনবিআরের নিজস্ব জনবলকে উপেক্ষা করে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
আজ রোববার এক বিবৃতিতে সরকার জানায়, এনবিআরের সব ধরনের চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত কর্মস্থলে ফিরতে বলা হয়েছে। সরকার হুঁশিয়ারি দিয়েছে—তারা কাজে না ফিরলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একদিকে এনবিআরে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার এবং অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগ—উভয় দিক সামাল দেওয়া সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য, প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে”—দুদক উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম
সারসংক্ষেপঃ
এনবিআরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং চলমান আন্দোলন—দুই মিলিয়ে রাজস্ব খাতে এক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এই অনুসন্ধান সত্যিই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে কিনা, তা এখন সময়ই বলে দেবে। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই তদন্ত কি সত্যিকারের দুর্নীতি প্রতিরোধ, নাকি আন্দোলন দমন করার নতুন কৌশল?
এম আর এম – ০১০০, Signalbd.com