দেশে ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক, ১০ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত। শিশুদের শ্রম থেকে মুক্ত রাখতে সরকারের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল (১৮ জুন) সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য এবং নতুন পদক্ষেপসমূহ জানানো হয়।
শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “শিশুশ্রম প্রতিরোধে যারা শিশুদের কাজে নিয়োগ দেবে তাদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। পাশাপাশি শিশুশ্রমের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে মিল রেখে শিশুদের কাজের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হবে।”
শিশুশ্রমের ভয়াবহ বাস্তবতা: ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি
বর্তমান শ্রম আইনের আওতায় ১৪ বছরের নিচের শিশুদের কাজ করানো শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হয়। আইন অনুযায়ী, এমন অপরাধের জন্য পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে বাস্তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ এতটাই সাধারণ যে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শ্রম উপদেষ্টা জানান, “দক্ষিণবঙ্গের নদীতে বাবা-মা মিলে জাল ও নৌকা নিয়ে মাছ ধরার সময় শিশুদেরও সঙ্গে নেয়া হয়। সেই শিশু আবার স্কুলেও যায়। এখন এই পরিস্থিতি শিশুশ্রম কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এজন্য সংজ্ঞা বদলাতে হবে।”
শ্রম আইন সংশোধনে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হবে
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, “কয়েক মাসের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধন করে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের লক্ষ্য যেন কেউ জোর করে শিশুকে কাজের জন্য পাঠাতে না পারে। যারা নিজেদের ইচ্ছায় স্কুলের পর স্বেচ্ছায় কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “শিশুদের কাজ থেকে মুক্ত রাখতে পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। শুধু সরকারের একার পক্ষে এ দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।”
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান ও বাংলাদেশের অবস্থান
১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশু শ্রম বন্ধের কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছর ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে আসছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এই বছর দিবসটি ১৯ জুন পালন করছে।
আইএলও ও ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ৫ কোটি ৪০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত। এদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কমেছে কিছুটা। ২০১৩ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিল ৩.২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে ২.৭ শতাংশ (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু) হয়েছে। তবে একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত থাকার হার সামান্য বেড়ে ৮.৭ শতাংশ থেকে ৮.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ইউনিসেফ ও আইএলও’র পরামর্শ
ইউনিসেফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শিশুশ্রম নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। বিশেষ করে অধিকাংশ শিশু অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, যেখানে কাজের পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং শিশুরা দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হয়।
ইউনিসেফের মতে, “গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধির কারণে কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের গতি এখনো যথেষ্ট নয়।”
আইএলও বাংলাদেশের প্রতিনিধি গুঞ্জন ডালাকোটি বলেন, “দেশে শিশুশ্রম নিরসনের অগ্রগতি স্থবির, দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন।”
সরকার আইএলও’র কনভেনশন সমর্থন করেছে
সরকার ইতিমধ্যে আইএলও’র কনভেনশন ১৩৮ ও ১৮২ অনুসমর্থন করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণসহ সকল শিশুশ্রম বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে। এ লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হচ্ছে।
শিশুশ্রম: সমস্যার মূলে রয়েছে দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু শ্রম বন্ধ করতে হলে দরিদ্র পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার মান ও সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। শিশুরা যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা পায়, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কাজ করার প্রবণতা কমবে।
শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনও এ বিষয়ে বলেন, “অনেক পরিবার তাদের শিশুকে ওস্তাদের কাছে কাজ শেখানোর জন্য পাঠায়। পরে সে নিজে মেকানিক বা কারিগর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু জোরপূর্বক কাজ করানো দণ্ডনীয় অপরাধ।”
শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা: সময়ের দাবি
শিশুশ্রম শুধু আইন বা অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, এটি একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠীকে মিলে শিশুশ্রমের চেইন ভাঙতে হবে। শিশুশ্রম নির্মূল করতে চাইলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি।
আগামী দিনের পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা
সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধন করবে বলে জানানো হয়েছে। নতুন আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুশ্রম প্রতিরোধে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সংজ্ঞা ও শিশুদের কাজের বয়সসীমা আন্তর্জাতিক মানের সাথে মিলিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমরা চাই না কোনও শিশু জোর করে কাজ করতে বাধ্য হোক। শিশুরা যেন প্রথমে ভালো শিক্ষা পায়, তার পরই প্রয়োজনে নিরাপদ পরিবেশে স্বেচ্ছায় কাজ করার সুযোগ পায়।”