বাংলাদেশ

‘জিজ্ঞাসাবাদ হবে কাঁচের ঘরে’, পুলিশের সংস্কার প্রসঙ্গে স্বরাস্ট্র উপদেষ্টা

গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানায় হঠাৎ পরিদর্শনে এসে পুলিশের মধ্যে মামলা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, যারা মামলার নামে দুর্নীতি ও বাণিজ্যে লিপ্ত থাকবেন, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, বরং বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্য দেশের পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও দুর্নীতিমুক্তি অভিযানের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে ৮৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে অ্যাটাচমেন্ট দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩০-৪০ জনকে ইতোমধ্যে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরো ৩০-৪০ জনকে একই রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে তিনি কোনোমতেই নাকচ করবেন না।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান

গাজীপুর গাছা থানায় পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন,
“বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। দুর্নীতি আমাদের সমাজ ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। যদি আমরা এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম, তাহলে দেশের উন্নয়ন অনেকগুণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেত।”

তিনি আরও বলেন, “আমি চাই সাংবাদিকরা এই ব্যাপারে সহযোগিতা করুন। আপনারা সত্য কথা প্রকাশ করলে সমাজ সচেতন হবে এবং দুর্নীতি কমে যাবে।”

মামলার প্রক্রিয়ায় আধুনিকায়ন ও স্বচ্ছতা

মামলা গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ এবং স্বচ্ছ করতে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এর ফলে, গ্রাহক বা সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনে জিডি (জেনারেল ডায়েরি) করতে পারবেন। আগের মতো থানায় এসে ঝামেলা পোহাতে হবে না।
“এখন জিডি করার জন্য মানুষকে থানায় যেতে হয় না, ফলে হয়রানি কমে এসেছে,” বলেন উপদেষ্টা।

এছাড়া, রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ ও সমস্যা কাটাতে পুলিশের জিজ্ঞাসা করার ঘরকে ‘কাচের মতো’ করে দেওয়ার কথা জানান তিনি, যাতে সবাই দেখতে পারবেন কাউকে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে কিনা।
এটি পুলিশি জোর এবং নির্যাতন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে তিনি মনে করেন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও মামলার দীর্ঘ তদন্ত

৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সংঘটিত বিভিন্ন হামলা ও সহিংসতা নিয়ে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আগে যেভাবে পুলিশ অসংখ্য অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মামলা দিত, সেটি এখন বদলেছে। এখন সুনির্দিষ্ট ১০-১৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার ব্যবস্থা হচ্ছে, কিন্তু সেই সাথে অনেক ‘বেনামি’ আসামির নামও যুক্ত হওয়ায় তদন্ত বিলম্বিত হচ্ছে।”

তিনি দাবি করেন, এমন অনেক মামলা রয়েছে যেখানে নির্দোষ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে, যা দুঃখজনক।
“আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো—দোষীদের বিচার নিশ্চিত করবো, আর নির্দোষদের যেন কোনও অবিচার না হয়।”

পুলিশ সংস্কার ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ পুলিশে সংস্কারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতিমুক্তির জন্য নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার একটি অংশ হিসেবে মামলা বাণিজ্য ও অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর এই উদ্যোগ দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সততা ফিরিয়ে আনার বড় একটি পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ করেন, তারা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

সাংবাদিকদের ভূমিকা: সত্য কথা জানানো ও দুর্নীতি দূরীকরণে সহায়তা

স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠু সংবাদ পরিবেশ গড়ে তুলতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আপনারা যদি সত্য কথা লেখেন, জনগণকে সচেতন করেন, তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আরও শক্তিশালী হবে।”

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল মিডিয়ায় তথ্যের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। সঠিক ও সত্য তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব।
উপদেষ্টার বার্তা থেকে স্পষ্ট, পুলিশ বাহিনীকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সাংবাদিকরা সরকারের অন্যতম হাতিয়ার।

অনলাইন জিডি: মামলার প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী পরিবর্তন

প্রথমবারের মতো অনলাইনে জিডি করার ব্যবস্থা চালু করার ফলে, দেশের মানুষের জন্য পুলিশের সেবা গ্রহণের পথ সহজ হয়েছে। আগে থানায় গিয়ে অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হতো। তবে এখন ঘরে বসেই অনলাইনে জিডি করার ফলে সময় ও খরচ দুটোই কমছে।

এটি দেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এছাড়া, এই পদ্ধতি পুলিশি দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহার কমাতেও সহায়ক হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশের কার্যক্রমে মনিটরিং ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মত, পুলিশে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
সার্বিকভাবে, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করে দেশকে আরও নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উন্নীত করা সম্ভব।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর ঘোষণাগুলো শুধু গাজীপুরেই নয়, পুরো বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও দুর্নীতিমুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিশা দেখিয়েছে। মামলা বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া, অনলাইন জিডির মাধ্যমে জনগণের সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি, এবং রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধে মনিটরিং বাড়ানো সহ আরও অনেক উদ্যোগ দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে উন্নত করবে বলে আশা করা যায়।

দেশের শান্তি ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সাংবাদিক, নাগরিক ও সরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই আমরা প্রত্যাশা করি, সকল বিভাগ এই বার্তা গ্রহণ করে বাস্তবায়নে কাজ শুরু করবে এবং দেশের মানুষ স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ ব্যবস্থার সুফল পাবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button