বাংলাদেশ

টঙ্গী উড়ালসেতুতে মুখোমুখি বাস দুর্ঘটনায় আহত ৩০

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী এলাকায় একটি ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা ঘটে। নবনির্মিত বিআরটি (বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট) প্রকল্পের উড়ালসেতুতে দুটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহতদের মধ্যে রয়েছেন উভয় বাসের চালক এবং আরও একজন যাত্রী।

ঘটনাটি ঘটে টঙ্গীর চেরাগ আলী অংশে, যেখানে উড়ালসেতু দিয়ে প্রতিদিন হাজারো যাত্রী যাতায়াত করে থাকেন। দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় চাঞ্চল্য দেখা দেয় এবং যান চলাচলে সাময়িক বিঘ্ন ঘটে। তবে ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পরপরই বাস দুটি সরিয়ে নিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।

কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, ঢাকাগামী নবাব সরকার পরিবহনের একটি বাস এবং টাঙ্গাইলগামী সোনিয়া পরিবহনের আরেকটি বাস বিপরীত দিক থেকে আসছিল। উড়ালসেতুর মাঝামাঝি অংশে পৌঁছেই তারা মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। উভয় বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায় এবং যাত্রীদের মাঝে চিৎকার ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শী মো. রাশেদ বলেন, “আমি নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি বাস দুটি একে অপরের ভেতরে ঢুকে গেছে। কয়েকজন যাত্রীকে জানালা দিয়ে বের হতে দেখেছি। দৃশ্যটি খুবই ভয়াবহ ছিল।”

আহতদের অবস্থা ও চিকিৎসা

আহতদের মধ্যে ৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে:

  • আব্দুর রহিম (২০)
  • সেফালী (৪০)
  • মাজেদুর রহমান (৩২)
  • নুরুননাহার (৪০)
  • আব্দুর রহমান (৪০)
  • তানজিলা আক্তার (৩০)
  • জেসমিন আক্তার (২৪)
  • বাকের হোসেন (২০)

তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছে স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গুরুতর আহত চালকদের মধ্যে একজনকে বাসের ভেতর থেকে উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিসকে কেটে বের করতে হয়েছে।

দ্রুত উদ্ধার কাজ চালিয়ে আহতদের গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও টঙ্গী হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিছু যাত্রীকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, “আটকে পড়া এক চালককে বাসের সামনের অংশ কেটে বের করতে হয়েছে। বাস দুটি ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং মহাসড়কে যান চলাচল বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে।”

তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে তদন্ত চলছে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতি ও দুই বাসচালকের অসতর্কতা এ ধরনের সংঘর্ষের জন্য দায়ী হতে পারে।

বিআরটি উড়ালসেতুর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

এই দুর্ঘটনা বিআরটি প্রকল্পের নিরাপত্তা ও পরিচালন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে চালু হওয়া এই উড়ালসেতু মূলত ঢাকাগামী ও ময়মনসিংহগামী বাস যাত্রাকে নিরবচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে নির্মিত হয়। প্রতিদিন হাজারো যাত্রী এই সেতু ব্যবহার করেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেতুতে পর্যাপ্ত গতিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং চালকদের প্রশিক্ষণের অভাবেই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার সময় সেতুতে ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য উপস্থিত ছিল না বলেও জানা গেছে।

পূর্ববর্তী দুর্ঘটনাগুলোর পর্যালোচনা

টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকায় বিগত এক বছরে এ ধরনের একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও একই মহাসড়কে একটি বাস ও একটি ট্রাকের সংঘর্ষে ৭ জন আহত হন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আরও কড়াকড়ি না আনলে ভবিষ্যতে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতামত

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাফিজুর রহমান বলেন, “বিআরটি প্রকল্পটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল একটি উদ্যোগ। কিন্তু এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় যদি গাফিলতি থাকে, তবে তা শুধু যাত্রীদের ঝুঁকিতেই ফেলবে না, বরং পুরো প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলবে।”

তিনি আরো বলেন, সেতুর প্রতিটি র‌্যাম্প ও সংযোগস্থলে সিসিটিভি ক্যামেরা, ট্রাফিক সেন্সর ও অ্যালার্মিং সিস্টেম যুক্ত করা জরুরি।

দুর্ঘটনার পরবর্তী পদক্ষেপ

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনাকবলিত বাস দুটি আটক রাখা হয়েছে এবং চালকদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত চলছে। তারা মাদকাসক্ত ছিলেন কি না, তাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে দুটি বাস কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশও করা হতে পারে।

এদিকে, দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এমন দুর্ঘটনার পর চিকিৎসা খরচ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ বাস কোম্পানিগুলোর কোনো দায়ভার নেই। অনেক যাত্রী তাদের চাকরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হারিয়ে ফেলেছেন।

টঙ্গী উড়ালসেতুতে আজকের এই মুখোমুখি বাস সংঘর্ষ শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং পুরো দেশের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। যাত্রী নিরাপত্তা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষ চালক নিয়োগ—এসব বিষয়কে উপেক্ষা করলে এমন ঘটনা আরও বাড়তে পারে।

সরকার ও সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের উচিত এই দুর্ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button