পাচার হওয়া অর্থ ফেরত ও সমর্থনের বিষয় অগ্রাধিকার

লন্ডন সফরে রাজা চার্লস ও প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ৯ জুন চার দিনের সফরে যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন। এই সফরে তার মূল অগ্রাধিকার পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, “আমাদের কাছে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আরও গভীর করার পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবে।”
রাজা চার্লসের সঙ্গে দেখা ও ‘হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ
১২ জুন অধ্যাপক ইউনূস ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে বাকিংহাম প্রাসাদে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। একই দিন বিকেলে তিনি সেন্ট জেমস প্রাসাদে রাজা চার্লসের হাত থেকে ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করবেন।
এই পুরস্কার শান্তি, সহনশীলতা ও বৈশ্বিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অধ্যাপক ইউনূসের এই পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও উজ্জ্বল করবে।
কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
১১ জুন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। এ বৈঠকে বাংলাদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে টেকসই করার বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, “বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে পাচার হয়েছে। আমরা এই অর্থ ফেরত আনার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্যক্তি ফেরত নয়, অর্থ ফেরতই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ সফর
রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, “এই সফর শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রেও এটি সহায়ক হবে।”
তিনি জানান, অধ্যাপক ইউনূস লন্ডনে অবস্থানকালে বিশ্বখ্যাত নীতিনির্ধারণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস-এর এক সংলাপে অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে তিনি ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর উদীয়মান ভূমিকায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা, জলবায়ু ন্যায্যতা এবং অর্থনৈতিক উত্তরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দেবেন।
অর্থ পাচারের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা চাওয়া হবে
বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি বৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার চুক্তি (Mutual Legal Assistance Treaty – MLAT) স্বাক্ষরের জন্য কাজ করছে। এ বিষয়ে রূপরেখা তৈরির চেষ্টা চলছে এবং অধ্যাপক ইউনূসের সফরে বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায়ে তোলা হবে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শুধু ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিভিন্ন পথ দিয়ে পাচার হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসতি, ব্যবসা কিংবা অফশোর অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে।
রাজনীতি থেকে দূরে, প্রশাসনের সংস্কারে নজর
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, বিচারিক নিরপেক্ষতা এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাজ্য সফরে এসব পদক্ষেপের অগ্রগতি তুলে ধরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবেন ইউনূস। এর ফলে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সমর্থন নিশ্চিত করা সহজ হবে।
প্রবাসী রাজনীতিকদের প্রসঙ্গও আসতে পারে
বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েকজন প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। এই সফরে তাদের দেশে ফেরানোর বিষয়টি কূটনৈতিক আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারনা করা হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে চায়নি।
তবে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, “আমরা ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনার চেয়ে অর্থ ফেরত আনার দিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এটি বাস্তবমুখী কূটনৈতিক অগ্রাধিকার।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ রয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য—এ তিন শক্তিধর কূটনৈতিক শক্তিই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়ে সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
এই প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।