বাংলাদেশ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী বিএসএফ সদস্যকে ফেরত দিল বিজিবি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আবারও অনুপ্রবেশের ঘটনা। এবার একজন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) সদস্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁকে স্থানীয় জনতা আটক করে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন এবং পরবর্তীতে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) হাতে তুলে দেন। অবশেষে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাঁকে ফেরত দিয়েছে বিজিবি।

ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার (৪ জুন) ভোর সকাল ৬টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের জহুরপুর সীমান্তে। আটক বিএসএফ সদস্যের নাম গণেশ মূর্তি (৪৩), যিনি ভারতের নুরপুর ৭১ বিএসএফ ক্যাম্পে সিনিয়র কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। বিজিবি জানায়, আটককালে তাঁর সঙ্গে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল এবং তিনি ছিলেন মদ্যপ অবস্থায়।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ

স্থানীয়দের বরাতে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে জহুরপুর সীমান্তের ১৯ নম্বর প্রধান সীমান্ত পিলারের ৫ নম্বর সাব পিলারের নিকটবর্তী সাতরশিয়া এলাকায় কয়েকজন রাখাল গরু ও ছাগল চরাচ্ছিলেন। আচমকা কিছু গবাদিপশু ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করলে বিএসএফ সদস্য গণেশ মূর্তি সেগুলো তাড়াতে তৎপর হন। একপর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন এবং এক রাখালকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

এই দৃশ্য দেখে এলাকাবাসী চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাঁরা গণেশ মূর্তিকে আটক করে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিজিবিকে খবর দেয়। এরপর বিজিবির ৫৩ ব্যাটালিয়নের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিএসএফ সদস্যকে হেফাজতে নেয়।

বিজিবি-বিএসএফ পতাকা বৈঠক

ঘটনার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিজিবি ও বিএসএফ কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজিবির পক্ষ থেকে এ ধরনের অনুপ্রবেশ ও মদ্যপ অবস্থায় সশস্ত্র প্রবেশের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।

পতাকা বৈঠকে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসে এবং ঘটনার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য বিএসএফ সদস্য গণেশ মূর্তিকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়। বিজিবির ৫৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফাহাদ মাহমুদ রিংকু এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিশ্চিত করেছেন যে, “আটকের সময় গণেশ মূর্তির দেহে অস্ত্র ও গুলি ছিল এবং তিনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ফেরত দেওয়া হয়েছে।”

সীমান্ত নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও, মাঝেমধ্যে বিএসএফ সদস্যদের অনুপ্রবেশ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, অস্ত্রসহ ও মদ্যপ অবস্থায় অনুপ্রবেশ কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন বলেই মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে সীমান্ত বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন, “এই ঘটনা শুধু সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাই নয়, বরং এটি ভারতীয় বাহিনীর আচরণ ও নৈতিকতারও প্রশ্ন তোলে।” বাংলাদেশ সরকার নিয়মিতভাবে সীমান্তে অহেতুক গুলিবর্ষণ ও অনুপ্রবেশ বন্ধে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও এ ধরনের ঘটনা থেমে নেই।

স্থানীয় জনতার ভূমিকা

এই ঘটনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক সাহসী ভূমিকা। সীমান্তে বিএসএফ সদস্যকে দেখে ভয় না পেয়ে তাঁরা তাঁকে আটক করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দেন। এতে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রতিফলন ঘটে।

একজন স্থানীয় রাখাল বলেন, “আমরা প্রথমে বুঝতেই পারিনি যে উনি বিএসএফ সদস্য। পরে দেখি তিনি গায়ে অস্ত্র বহন করছেন এবং এক রাখালকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তখন সবাই মিলে তাঁকে ধরে ফেলি।”

সাম্প্রতিক সীমান্ত পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত বরাবরই সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে পরিচিত। মাদকপাচার, গরু চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে এ সীমান্তে বিজিবিকে সর্বদা সতর্ক অবস্থানে থাকতে হয়। অতীতেও এ সীমান্ত দিয়ে অনেক সময় বিএসএফ সদস্যদের অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ উঠেছে, যা দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এমন দায়িত্বহীন আচরণ বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো প্রয়োজন। একইসঙ্গে সীমান্তে যৌথ টহল বাড়ানো, নজরদারি ক্যামেরা স্থাপন এবং কমান্ডার পর্যায়ের নিয়মিত সভা আয়োজন করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমে আসবে।

বিএসএফ সদস্য গণেশ মূর্তির অনুপ্রবেশ ও তাৎক্ষণিকভাবে জনতা ও বিজিবির যৌথ পদক্ষেপে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হয়ে থাকবে। এটি প্রমাণ করে যে দেশের জনগণ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী একসঙ্গে কাজ করলে যেকোনো নিরাপত্তা হুমকি সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব।

তবে এর পাশাপাশি এ ঘটনাটি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জন্যও একটি সতর্কবার্তা হয়ে থাকা উচিত—যাতে ভবিষ্যতে তাদের বাহিনীর সদস্যরা আর এমন দায়িত্বহীন আচরণে জড়াতে না পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button