ঈদযাত্রায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৩ সদস্য নিহত

ঈদের আনন্দ আর পরিবারে একসাথে সময় কাটানোর আশায় রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রামের পথে রওনা দিয়েছিলেন আমজাদ মণ্ডল। স্ত্রী, সন্তান ও নাতি-নাতনিসহ মোট আটজন সদস্য একটি মাইক্রোবাসে করে যাচ্ছিলেন শেরপুরের কামারচর গ্রামের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঈদের সেই যাত্রা মুহূর্তেই রূপ নেয় দুঃস্বপ্নে।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের করটিয়া বাইপাস এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এই পরিবারের তিন সদস্য—আমজাদ মণ্ডল (৬৫), তাঁর বড় ছেলে রাহাত মণ্ডল (২৬) ও ছোট ছেলে অতুল মণ্ডল (১৪)। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আমজাদের স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৬০), বড় ছেলের স্ত্রী মরিয়ম (২৫) ও গাড়িচালক নাজমুল (৪০)। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁদের ভর্তি করা হয়েছে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে।
❝একটা পরিবার থেকে একসাথে চলে গেল তিনজন—এটা সহ্য করার মতো না❞
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে শয্যাশায়ী মাকসুদা বেগম ও পুত্রবধূ মরিয়ম তখনো জানেন না, একই দুর্ঘটনায় তাঁদের স্বামী ও ছেলেরা মারা গেছেন। মরিয়মের কোলে রয়েছে তাঁর দুই সন্তান—তিন বছরের মাহফুজ ও দেড় বছরের রজমনি। তিনি অজান্তেই স্বামীর খোঁজ করছেন। স্বজনরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, ‘ওরা নিচতলায় ভর্তি আছে, চিন্তার কিছু নেই।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো—তিনটি নিথর দেহ পড়ে আছে পুলিশ ফাঁড়িতে।
মাকসুদার ভাশুরের ছেলের স্ত্রী পপি বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“একটা পরিবার থেকে তিনজন মানুষ একসাথে চইলা গেছে। এ কথা জানার পর ওদের কী অবস্থা হইব, এত কষ্ট ওরা সহ্য করব কেমনে?”
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
পুলিশ জানায়, সকাল ৯টার দিকে শেরপুরগামী মাইক্রোবাসটি করটিয়া বাইপাসের করাতিপাড়া এলাকায় পৌঁছালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের পেছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনজন। ধারণা করা হচ্ছে, চালক হয়তো ক্লান্ত ছিলেন বা গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হন।
মির্জাপুরের গোড়াই হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জানান, নিহতদের মরদেহ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে এবং স্বজনেরা আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে লাশ গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কে ছিলেন এই তিনজন?
নিহত আমজাদ মণ্ডলের বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার কামারচর গ্রামে। তিনি ঢাকার বাড্ডা এলাকায় পরিবারসহ থাকতেন এবং একটি কনস্ট্রাকশন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বড় ছেলে রাহাত পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করতেন। ছোট ছেলে অতুল ছিলেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
স্বজন আশরাফুল ইসলাম বলেন,
“নিহতদের মধ্যে দুজন উপার্জনক্ষম ছিলেন। তাঁদের আয়েই পরিবার চলত। এখন তাঁরা আর নেই, এই পরিবারের সামনে শুধুই অন্ধকার।”
শিশুরা বেঁচে গেলেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে থাকা মাকসুদার মেয়ে ও মরিয়মের দুই সন্তান অলৌকিকভাবে অক্ষত থাকলেও তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার। এত বড় ট্র্যাজেডির পর এই ছোট শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠবে, কীভাবে গড়ে উঠবে তাঁদের ভবিষ্যৎ—তা নিয়ে স্বজনরা দুশ্চিন্তায়।
সড়ক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ
ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপের সময় সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। কিন্তু এবার একসাথে একটি পরিবারের তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে আবারও সড়ক নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয়দের দাবি, মহাসড়কে এমনভাবে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকা কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। তাদের বক্তব্য,
“দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক যদি সঠিক নিয়মে সিগন্যাল দিত বা রোড সেফটির মান বজায় রাখত, তাহলে হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না।”
একটি পরিবার, যারা একসাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে যাচ্ছিল, আজ তারা শুধুই শোক আর অশ্রুতে ভাসছে। একই সঙ্গে হারিয়েছে পরিবারপ্রধান, দুই সন্তান ও রোজগার করার মানুষদের। যারা জীবিত আছেন, তাঁদের সামনে এখন শুধুই শোক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।