আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সালাহউদ্দিন গুমের অভিযোগ, শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ৭ জন

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ২০১৫ সালের নিজের গুমের ঘটনার বিচার চেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাতজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন। ২০২৫ সালের ৩ জুন মঙ্গলবার সকাল ১১টায় তিনি রাজধানীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে এই অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগে যাদের নাম রয়েছে
সালাহউদ্দিনের অভিযোগে নাম উঠে এসেছে দেশের সাবেক ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। তাদের মধ্যে রয়েছেন:
- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল
- সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ
- সাবেক র্যাব কর্মকর্তা ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম
- সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার সাবেক কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান
- সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া
- সাবেক আইজি একে এম শহীদুল হক
এই অভিযোগে সালাহউদ্দিন দাবি করেছেন, তার গুম পরিকল্পিত ও রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট ছিল এবং এই সাতজন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতে জড়িত ছিলেন।
সালাহউদ্দিন কী বলেছেন?
অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির এই সিনিয়র নেতা। তিনি বলেন,
“বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট আমলে যারা গুম, খুন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের সবার যেন বিচার হয়, সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমি চাই, সবাই সাহস করে মামলা করুক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়, তার জন্য আমরা সকলে লজিস্টিক সহায়তা বাড়ানোর অনুরোধ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “এই জাতির আকাঙ্ক্ষা হলো ন্যায়বিচার। শুধু আজকের ঘটনা নয়, বিগত ১৫ বছর ধরে যারা নিখোঁজ হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের জন্যও বিচার চাই।”
পটভূমি: সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা
২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকার উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। দলীয় নেতাকর্মীদের দাবি ছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তবে সরকার তখন এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
দুই মাস পর, ১১ মে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে স্থানীয় পুলিশ তাকে খুঁজে পায়। সেখানকার পুলিশ জানায়, সালাহউদ্দিন বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে প্রবেশ করেছেন। তার বিরুদ্ধে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তীতে ভারতের একটি আদালত সেই মামলায় সালাহউদ্দিনকে খালাস দেয়। এরপর তিনি বেশ কিছুদিন চিকিৎসা ও আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে ভারতে অবস্থান করেন। তার স্ত্রীও অভিযোগ করেছিলেন, সালাহউদ্দিনকে গুম করা হয়েছিল এবং এতে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল।
মামলার ধরন ও প্রক্রিয়া
এবার সরাসরি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করলেন সালাহউদ্দিন। এই ট্রাইব্যুনাল সাধারণত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বিচার করে থাকে। তবে কিছু বিশেষ ব্যতিক্রমী ঘটনা, যেমন রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গুম, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলাও এখানে আনা হয়েছে বিগত সময়ে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মামলাটি গৃহীত হলে তদন্ত শুরু হবে এবং অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন সংস্থা ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য নেওয়া হতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই মামলার খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপি নেতারা একে “ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাহসী পদক্ষেপ” বলে বর্ণনা করছেন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।
তবে সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, সালাহউদ্দিনের অভিযোগ “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত” এবং “আওয়ামী লীগকে হেয় করতেই এই অভিযোগ তোলা হয়েছে।” কেউ কেউ বলছেন, এটি বিএনপির নির্বাচনের আগমুহূর্তে পরিকল্পিত প্রচার।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ
এই মামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, গুম একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন। জাতিসংঘের অধীনে ‘ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স কনভেনশন’-এও বিষয়টি স্পষ্টভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত।
মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ ও ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ ২০১৫ সাল থেকেই সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও বিচারপ্রক্রিয়ার সম্ভাবনা
আইনজীবীদের মতে, যদি অভিযোগপত্র গৃহীত হয়, তাহলে পরবর্তী ধাপে তদন্ত হবে এবং অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হতে পারে। তবে যেহেতু অভিযুক্তরা কেউই বর্তমানে ক্ষমতায় নেই এবং অনেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, তাই বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে
সালাহউদ্দিন আহমদের অভিযোগ একটি বড় মাইলফলক হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুম, খুন ও নিপীড়নের অভিযোগগুলোর বিচারপ্রক্রিয়ায়। এটি একদিকে যেমন ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়ের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, অন্যদিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শাসকদের জন্য একটি বার্তা— রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে কেউ যেন গুম বা নিপীড়নের দায় এড়াতে না পারে।