
বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন আবারও বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তাপে উত্তাল। এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। সোমবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই বক্তব্য দেন।
ট্রাম্প বলেছেন,
“আমরা চাই চীন আমাদের আরও বেশি ম্যাগনেট সরবরাহ করুক। যদি তারা তা না করে, তবে তাদের পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি শুল্ক আরোপ করা হবে।”
এই হুমকি এসেছে এক সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি শিল্প বিশেষ করে সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদন ব্যাপকভাবে বিরল খনিজের ওপর নির্ভরশীল। আর এই খনিজের বেশিরভাগই চীন থেকে আসে।
বিরল খনিজ ও ম্যাগনেটের গুরুত্ব
বিরল খনিজ (Rare Earth Elements) আজকের বিশ্ব প্রযুক্তি খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এগুলো ছাড়া তৈরি সম্ভব নয়—
- স্মার্টফোন ও কম্পিউটার চিপ
- ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি
- সোলার প্যানেল
- ডিফেন্স সিস্টেম ও মিসাইল টেকনোলজি
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ ম্যাগনেট উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির জবাবে চীন ম্যাগনেট ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। এর ফলে মার্কিন প্রযুক্তি শিল্পে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
চীনের কৌশল এবং রপ্তানি প্রবণতা
চীনের কাস্টমস তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে বিরল খনিজের রপ্তানি ৪,৭০০ টন বেড়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে—চীন তার প্রভাব আরও বাড়াতে চাইছে। কারণ বিশ্বজুড়ে এই উপকরণের বিকল্প এখনো তেমন নেই।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই আধিপত্য ঠেকাতে নতুন বিনিয়োগ ও বিকল্প সরবরাহকারী খোঁজার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি ইন্টেল করপোরেশনে ১০ শতাংশ শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন, যা ট্রাম্পের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
বাণিজ্য যুদ্ধের পটভূমি
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন কিছু নয়।
- ২০১৮ সালে প্রথম এই বাণিজ্য সংঘাত শুরু হয়, যখন ট্রাম্প চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন।
- ২০২০ সালে দুই দেশ আংশিক সমঝোতায় পৌঁছালেও সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি।
- এবার নতুন হুমকির মাধ্যমে সেই উত্তেজনা আবার বেড়ে গেছে।
ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনা কী?
হোয়াইট হাউসের সূত্র মতে—
- ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্কের একটি প্রস্তাব প্রস্তুত রেখেছে।
- এর বাইরে প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
- বিরল খনিজের বিকল্প উৎস হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা চলছে।
চীনের প্রতিক্রিয়া
চীন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে বেইজিং-এর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে—
“যদি যুক্তরাষ্ট্র ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্য আবারও বিপর্যস্ত হতে পারে।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন,
এই শুল্ক আরোপ হলে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ও প্রযুক্তি খাতে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
এই পরিস্থিতির প্রভাব শুধু চীন বা যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
- বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারে চিপের দাম বাড়বে।
- স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও ইলেকট্রনিক পণ্যের দাম বাড়বে।
- ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদন ধাক্কা খাবে।
বিশ্লেষকদের মতামত
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—
- ২০০ শতাংশ শুল্ক হলে মার্কিন ভোক্তাদের ব্যয় আরও বাড়বে।
- চীনের রপ্তানি কমবে, তবে চীনের বিকল্প সরবরাহকারী না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রকেও সংকটে পড়তে হবে।
- এতে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি আরও তীব্র হতে পারে।
পূর্বের সমঝোতা কেন ব্যর্থ হলো?
গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক চুক্তিতে পৌঁছায় যে—
- শুল্ক ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হবে।
- যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
কিন্তু বাস্তবে এই সমঝোতা কার্যকর হয়নি। ট্রাম্প পরে একটি নির্বাহী আদেশে শুল্ক কার্যকরের সময়সীমা ৯০ দিন বাড়ান।
চলমান এই বাণিজ্য বিরোধ আবারও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
যদি শিগগির সমাধান না হয়, তবে প্রযুক্তি শিল্প, গাড়ি শিল্প এবং ভোক্তা বাজার ভয়াবহ প্রভাবের মুখে পড়বে।
MAH – 12482 , Signalbd.com