বানিজ্য

বিনিয়োগ কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নয়: আশিক মাহমুদ

বিনিয়োগকে রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে রেখে জাতীয় স্বার্থে বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। তিনি বলেছেন, “ইনভেস্টমেন্ট ইজ নট এ পলিটিক্যাল এজেন্ডা—এটা সবার জন্য প্রয়োজন। যারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসবে, তাদের জন্য বিনিয়োগ প্রচারই হবে প্রাথমিক অগ্রাধিকার।”

রবিবার (১ জুন) ঢাকার আগারগাঁও বিনিয়োগ ভবনে আয়োজিত দিনব্যাপী চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলন শেষে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন তিনি। চীনের ১৪৩টি কোম্পানির প্রায় আড়াইশ’ বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধির অংশগ্রহণে আয়োজিত এই সম্মেলনটি বিনিয়োগ প্রসারে একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এবং বাংলাদেশের সুযোগ

চৌধুরী আশিক মাহমুদ উল্লেখ করেন, “চীন আগামী দশকে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎস হতে যাচ্ছে।” তার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। আর চীনের মতো দেশ, যারা প্রযুক্তি, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী খাতে ব্যাপক দক্ষ, তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে পারে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সস্তা মূল্য এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তা চাহিদা চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বলে জানান আশিক মাহমুদ। এছাড়া, বাংলাদেশের চলমান সংস্কারমূলক কার্যক্রমেও চীনা বিনিয়োগকারীরা পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল ও শিল্পপার্কে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ চলমান রয়েছে।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন

বিনিয়োগকে রাজনৈতিক বিতর্ক বা মতভেদ থেকে দূরে রাখার আহ্বান জানিয়ে আশিক মাহমুদ বলেন, “যে কোনো সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে বিনিয়োগ প্রমোট করা সকলের মৌলিক দায়িত্ব।” তিনি মনে করেন, দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ন্যূনতম ঐক্য থাকা দরকার যে বিনিয়োগ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রাখে।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা যে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য কাজ করছি, সেই প্রক্রিয়া যেন ভবিষ্যতের সরকারগুলোও একইভাবে বজায় রাখে—এটাই প্রত্যাশা।”

সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সতর্কতা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন

দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় অনেক সময়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আশিক মাহমুদ স্পষ্টভাবে জানান, “বৈদেশিক বিনিয়োগ আমাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি নয়, বরং এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ।” তিনি বলেন, আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আন্তঃনির্ভরতা একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং এ থেকেই পারস্পরিক উন্নয়নের পথ তৈরি হয়।

তবে, তিনি জানান যে সরকার অত্যন্ত সচেতনভাবেই এসব বিনিয়োগের প্রক্রিয়া পরিচালনা করছে এবং জাতীয় স্বার্থে কোনো ধরনের আপস করা হবে না।

জ্বালানি সংকটের প্রভাব ও পরিকল্পনা

জ্বালানি সংকট বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই সংকট বিনিয়োগ আকর্ষণে সরাসরি প্রভাব ফেলছে না বলে মন্তব্য করেন বিডা ও বেজার চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “বিনিয়োগকারীরা এখনই সরাসরি বিনিয়োগ করছেন না। তারা সম্ভাবনা যাচাই করছেন, খাতভিত্তিক মূল্যায়ন করছেন। ফলে আমরা অন্তত এক বছর সময় পাচ্ছি নিজেদের প্রস্তুত করার।”

এই সময়ে আমদানি বাড়িয়ে জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। বলেন, “আমাদের এই কর্মযজ্ঞের সুফল পেতে হলে এখনই পরিকল্পিতভাবে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি প্রসার ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।”

অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলনে যে খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, সেগুলো হলো—তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্যপ্রযুক্তি। এই খাতগুলোতে চীন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে এবং বাংলাদেশও ক্রমবর্ধমানভাবে এই খাতগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাকের পর কৃষি ও খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত খাতও সামনে আসছে। এই খাতগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং দক্ষ জনবল তৈরি করতে চীনের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আশিক মাহমুদ।

সম্মেলনের তাৎপর্য

উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস, চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েন্তাও, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট অতিথিরা। এছাড়া দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা ও বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধিরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনটি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।

এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগ সহযোগিতা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হলো, তা আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে বৈদেশিক বিনিয়োগ অপরিহার্য। আর সেই বিনিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে, জাতীয় স্বার্থে পরিচালনা করাই উচিত। চীনকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে, পরিকল্পিত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারলে আগামী দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ভিত্তি লাভ করবে—এমনটাই বিশ্বাস চৌধুরী আশিক মাহমুদের।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button