বানিজ্য

মে মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৯৭ কোটি ডলার

Advertisement

বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থে চলতি মে মাসে বড় ধরনের অগ্রগতি দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের মে মাসে দেশে ২৯৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। এ তথ্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহের বিস্তারিত পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের প্রথম ১১ দিনে রেমিট্যান্স আসে ৯২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এই সময় গড় রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল দৈনিক প্রায় ৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। পরবর্তী ২০ দিনে এসেছে আরও প্রায় ২২০ কোটি ডলার, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে এসেছে ১১ কোটি ডলার। এই তথ্য ইঙ্গিত দেয়, মাসের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

অপরদিকে, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৭৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) যার পরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। মে মাসে এই অঙ্ক আরও বেড়ে প্রায় ৩৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক মাসেই প্রায় ২,৬০০ কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স বেড়েছে।

রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পেছনের প্রেক্ষাপট

বর্তমান রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত হওয়ায় এবং নতুন সরকারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগে প্রবাসীদের আস্থা বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো কমিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রত্যাশায় প্রবাসীদের আস্থা ফিরতে শুরু করে।

ফলে, জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে ক্রমান্বয়ে উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের মধ্যে দেশের প্রতি আস্থা ফিরে আসা এবং বিদেশি মুদ্রা পাঠাতে উৎসাহমূলক সরকারি পদক্ষেপই মূলত এই অগ্রগতির পেছনে কাজ করছে।

সরকারের উদ্যোগ ও প্রণোদনা

বর্তমান সরকার রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে একাধিক প্রণোদনা চালু রেখেছে। রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে ২.৫ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রয়েছে, যা আগের সরকারের সময়েও ছিল। তবে এখন তা পাওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও ডিজিটাল করা হয়েছে।

তাছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর ক্যাম্পেইনও চালানো হয়েছে। এতে করে হুন্ডি বা অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠানোর প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে বলে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব

রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। মে মাস শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অর্থ দিয়ে সরকারের খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধসহ জরুরি আমদানি ব্যয় মেটাতে সুবিধা হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. আকরাম হোসেন বলেন, “রেমিট্যান্স হলো আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন। দেশের কর্মসংস্থান, আমদানি ব্যয়, টাকার বিনিময় হার—সব কিছুতেই এর বড় প্রভাব পড়ে। প্রবাসীরা আবার অর্থ পাঠাতে শুরু করায় আমরা একটা ইতিবাচক চক্রে ঢুকছি।”

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে, তবুও স্থায়ীভাবে এই ধারা বজায় রাখতে সরকারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর করতে হবে। সেই সঙ্গে অবৈধ হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।

অন্যদিকে, প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে একটি স্থায়ী এবং নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যক্রম আরও গতিশীল করার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

উপসংহার

মে মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির জন্য এক আশার আলো। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবাসীদের আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এই ধারা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সঠিক নীতি, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও টেকসই ও উৎপাদনমুখী করা সম্ভব।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button