অর্থনীতি

ব্যাংক খাতে লুটপাটে লাগাম, সংস্কারে জোর দিয়েছে নতুন সরকার

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাতে চলে আসা অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ধারায় এবার বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নতুন সরকারের অধীনে ব্যাংক খাতে লুটপাট অনেকটাই থেমেছে এবং সংস্কারের নানা উদ্যোগ ইতোমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। যদিও চূড়ান্ত সমাধান এখনো আসেনি, তবে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ গ্রাহকেরা।

ব্যাংক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের হাওয়া

আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে যেভাবে ব্যাংক থেকে অর্থ লোপাট ও অপব্যবস্থাপনা চলছিল, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই ধারা থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে অনিয়মে জর্জরিত অন্তত ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করেছে। যদিও এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তবে গ্রাহক আস্থা কিছুটা হলেও ফিরেছে।

এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “ব্যাংক খাতে যে ক্ষত হয়েছে, তা অপূরণীয়। তবে বর্তমান সরকার সেটি থামাতে পেরেছে, এটা একটি বড় অর্জন।”

খেলাপি ঋণে উদ্বেগ, আস্থার ঘাটতি

তবে ভালো খবরের পাশাপাশি উদ্বেগের খবরও রয়েছে। গত বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়, যা বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। এ ছাড়া জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এ পরিমাণ খেলাপি ঋণের পেছনে রয়েছে পুরোনো আমলের নামে-বেনামে ঋণ, রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের অভাব। যদিও ব্যাংকগুলো এখন এসব তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা আনতে শুরু করেছে, যা আগে গোপন রাখা হতো।

সংস্কারের পথে সরকার: রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ও একীভূতকরণ পরিকল্পনা

নতুন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ অনুমোদন, যার অধীনে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ কিংবা অবসায়ন করা যাবে। এতে করে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কার সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ছয়টি ইসলামি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে। ব্যাংকগুলো হলো:

  • সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক
  • গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
  • আইসিবি ইসলামী ব্যাংক
  • এক্সিম ব্যাংক
  • ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
  • ইউনিয়ন ব্যাংক

এই ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণমান যাচাইয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে এদের পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন: কতটা বাস্তবায়নযোগ্য?

বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে ও এর সক্ষমতা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের চিন্তা করা হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, কেবল নীতিগত ঘোষণা যথেষ্ট নয়; এটি বাস্তবে প্রয়োগ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুনাফা কে মুজেরী বলেন, “ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে কেবল পরিবর্তন নয়, জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।”

আমানতের প্রবৃদ্ধি কমছে, বিনিয়োগ স্থবির

গ্রাহক আস্থা হ্রাস পাওয়ায় ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধিও মন্থর হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বাজার স্থবিরতার কারণে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন খাতেও।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, “ঋণ চাহিদা কম থাকার ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। সরকারকে এই দিকে মনোযোগী হতে হবে।”

পেছনের গল্প: কীভাবে শুরু হয়েছিল এই বিপর্যয়?

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম মেয়াদে হলমার্ক কেলেঙ্কারিবেসিক ব্যাংকে অনিয়ম দেশের ব্যাংক খাতকে নাড়া দেয়। পরবর্তী মেয়াদগুলোতে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলম বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লুটপাট শুরু করেন।

ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংকে অর্থ লোপাট হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই তহবিল সরবরাহ করে বলে অভিযোগ উঠে।

বিদায়ী সরকারের সময়ে কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর থেকে এসব ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। জানা গেছে, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো এখন প্রকৃত আর্থিক চিত্র তুলে ধরছে।

বিদেশে অর্থ পাচার ও দায়মুক্তি: কে দেবে জবাব?

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) অর্থ পাচার রোধে সামান্য সক্রিয় হলেও এখনো বড় কোনো গ্রাহক বা ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু নেতা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, “দায়ীদের বিচার না হলে সংস্কারের প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না।”

সামনে কী চ্যালেঞ্জ?

বর্তমানে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো — আস্থা ফিরিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া। পাশাপাশি প্রয়োজন অর্থ পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, কেবল পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন বা নীতিগত ঘোষণা যথেষ্ট নয়; বাস্তবায়নই মূল চাবিকাঠি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button