ট্রাম্পের শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তার জেরে এশিয়ার শেয়ারবাজারে ধস

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার কারণে এশিয়ার পুঁজিবাজারে তীব্র অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার এশিয়ার প্রধান শেয়ারবাজারগুলোর সূচক নিম্নমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে, যা মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপ স্থগিতের বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউসের আপিলের ফলাফলের জেরে সৃষ্ট হয়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ককে স্থগিত ঘোষণা করলেও হোয়াইট হাউসের আপিলের কারণে এই রায় স্থগিত হয়। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে এশিয়ার শেয়ারবাজারে।
শেয়ারবাজারে পতনের প্রেক্ষাপট
গত শুক্রবার জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক ১.১ শতাংশ কমে যায়। জাপানের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে খাদ্য ও জ্বালানিবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৩.৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশ্লেষকদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। এই তথ্য ব্যাংক অব জাপানের (বিওজে) সুদহার বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করেছে, যা বাজারে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতির এই উচ্চ হার এবং সম্ভাব্য সুদহার বৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
এদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি সূচক ০.৯ শতাংশ, হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক ১.৪ শতাংশ এবং সাংহাই কম্পোজিট সূচক ০.৩ শতাংশ কমেছে। এই পতনের পেছনে ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। তবে, বৃহস্পতিবার ওয়াল স্ট্রিটের সূচকগুলো কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ০.৪ শতাংশ, ডাও জোনস ০.৩ শতাংশ এবং নাসডাক কম্পোজিট ০.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উত্থানের পেছনে প্রযুক্তি খাতের শেয়ারের দাম বৃদ্ধি, বিশেষ করে চিপ কোম্পানি এনভিডিয়ার শেয়ার ৩.২ শতাংশ বেড়ে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
শুল্ক নিয়ে আইনি জটিলতা
মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালতের রায়ে বলা হয়, ট্রাম্প ১৯৭৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্টের আওতায় যে শুল্ক আরোপ করেছেন, তা সংবিধানসম্মত নয়। আদালতের মতে, এই আইন প্রেসিডেন্টকে শুল্ক আরোপের ক্ষমতা দেয় না; এই ক্ষমতা একমাত্র কংগ্রেসের হাতে রয়েছে। ফলে, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই রায় প্রথমে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুটা স্বস্তি এনেছিল। কিন্তু হোয়াইট হাউসের আপিল এবং আদালতের রায় স্থগিত হওয়ায় বাজারে আবারও অনিশ্চয়তা বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সার্কিট আদালত গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, তারা সরকারের আপিল বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য আদালতের রায় স্থগিত রাখছে। মামলার বাদীপক্ষকে ৫ জুন এবং ট্রাম্প প্রশাসনকে ৯ জুনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, তারা এই রায় নিয়ে বিচলিত নয় এবং আপিলে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। প্রয়োজনে প্রেসিডেন্টের অন্যান্য নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারের ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্প নিজে এক বিবৃতিতে মার্কিন বিচার বিভাগকে ‘আমেরিকাবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “আশা করি, সুপ্রিম কোর্ট এই ভয়ংকর ও দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ রায় বাতিল করবে।” তিনি আরও বলেন, “এই রায়ে বলা হয়েছে, শুল্ক আরোপের আগে আমাকে কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হবে। যদি এই রায় বহাল থাকে, তবে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব
ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে এই আইনি লড়াই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যান্য শুল্ক—যেমন ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ি—অন্য আইনের আওতায় থাকায় এই রায়ের প্রভাব সেগুলোর ওপর পড়বে না। তবে, শুল্কনীতি নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশকে অস্থির করে তুলেছে।
ইউবিএস গ্লোবাল ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের গ্লোবাল ইকুইটিজ বিভাগের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা উলরিকে হফম্যান-বুরচার্ডি বলেন, “ট্রাম্প এখনো ভিন্ন উপায় অবলম্বন করে দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল পরিমাণে শুল্ক আরোপে সক্ষম।” তিনি আরও জানান, এই ধরনের নীতি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল এবং বাণিজ্য প্রবাহের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে মিশ্র বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনীতি পূর্বাভাসের তুলনায় কম সংকুচিত হয়েছে, তবে বেকার ভাতার আবেদন বেড়েছে। এই পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও সতর্কতা তৈরি করেছে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিরুদ্ধে পাঁচটি ছোট ব্যবসায়ী জোটের পক্ষ থেকে মামলা করেছিল লিবার্টি জাস্টিস সেন্টার। তাদের দাবি, এই শুল্কের কারণে ব্যবসাগুলো সরবরাহকারীদের হারিয়েছে এবং তাদের ব্যয়বহুল সরবরাহব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আইনজীবী জেফরি শ্যাব বলেন, “এসব ব্যবসা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। শুল্কের কারণে তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে গেছে।”
অন্য একটি মামলায় আদালত ট্রাম্পের ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এবং ২৫ শতাংশ ফেন্টানিল-সম্পর্কিত শুল্ককেও আইনের অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে, এই রায় কেবল খেলনা কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বিশ্ববাজারে প্রভাব
মে মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার সামগ্রিকভাবে চাঙা অবস্থায় ছিল। তবে, ডলার ইনডেক্স টানা মাস কমেছে, যা বিশ্বের প্রধান ছয়টি মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া, মাসের শেষ দিনে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেল ও সোনার দামও কমেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে চলমান এই অনিশ্চয়তা আগামী দিনগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর আরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, এশিয়ার অর্থনীতিগুলো, যারা বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, তারা এই পরিস্থিতির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
উপসংহার
ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে আইনি ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এশিয়ার শেয়ারবাজারে ধস এবং বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এই নীতির প্রভাবেরই প্রতিফলন। আগামী দিনে এই আইনি লড়াইয়ের ফলাফল এবং ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনীতির দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।