বানিজ্য

অনলাইনে আম বিক্রির উত্থান: তরুণ উদ্যোক্তাদের নতুন সম্ভাবনা

বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল মানেই আমের মৌসুম। এই মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমের বাম্পার ফলন হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমের বাজারে একটি নতুন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে—অনলাইনে আম বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তারা এই খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন।

অনলাইনে আম বিক্রির বর্তমান চিত্র

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আম বিক্রি এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগান থেকে অথবা স্থানীয় বাজার ও চাষিদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি করছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে বর্তমানে ৫,০০০-এর বেশি ছোট-বড় বিক্রেতা অনলাইনে আম ও অন্যান্য মৌসুমি ফলের ব্যবসা করছেন। এর মধ্যে গ্রীষ্মকালীন আমের ব্যবসাই সবচেয়ে বড়, কারণ আমের চাহিদা অন্যান্য ফলের তুলনায় বেশি।

তরুণ উদ্যোক্তাদের পদচারণা

অনলাইনে আম ব্যবসায় তরুণদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রীদওয়ানুল আলম একটি উদাহরণ। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে বাবার ব্যবসার হাল ধরতে নিজ এলাকায় ফিরে যান। ফেসবুকে ‘আমবাজার-চাঁপাই’ নামে একটি পেজ খুলে ১৭ মে থেকে অনলাইনে আম বিক্রি শুরু করেন। তিনি বালিয়াডাঙ্গা, মহারাজপুর ও কাশিমপুর এলাকার ৮০টি গাছের আম কিনে ৪৬ মণ আম বিক্রি করেছেন।

কুরিয়ার সার্ভিসের ভূমিকা

অনলাইনে বিক্রি হওয়া আম সাধারণত কুরিয়ার সার্ভিস বা বাসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। ক্রেতারা কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয় থেকে আম সংগ্রহ করেন, আবার কিছু কুরিয়ার সার্ভিস বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার সেবাও প্রদান করে। স্টেডফাস্ট কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিদওয়ানুল বারী জানান, তাদের মাধ্যমে ১৫০ থেকে ২০০ জন আম ব্যবসায়ী আম পাঠান। এ বছর অনলাইনে বিক্রি করা আমের পরিবহন খরচ বেড়েছে। শুধুমাত্র সাতক্ষীরা থেকে ১৫০ টন আম তাদের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়েছে।

অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি

ফেসবুকের পাশাপাশি অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও আম বিক্রি হচ্ছে। ‘ফজলি ডট কম’ ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ২০১২ সালে ওয়েবসাইট চালু করেন। তার ৪০ বিঘা আমের বাগান রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। অনলাইনে চাহিদা মেটাতে রাজশাহী, রংপুর ও সাতক্ষীরা থেকে আম সংগ্রহ করতে হয়। গত বছর তিনি অনলাইনে প্রায় ৭০,০০০ কেজি আম বিক্রি করেছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ শেষ করা হাসান তানভীর ২০১৩ সালে ‘রাজশাহী ম্যাঙ্গো’ নামে ফেসবুক পেজ খুলে আম বিক্রি শুরু করেন। ২০১৮ সালে ওয়েবসাইট এবং ২০১৯ সালে মোবাইল অ্যাপ চালু করেন। গত বছর তিনি অনলাইনে ৮০,০০০ কেজি আম বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, প্রতিবছর অনলাইনে আম বিক্রি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।

প্রতারণার ঝুঁকি

অনলাইনে আম বিক্রির পাশাপাশি প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। তবে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনলাইনে আম কিনলে হোম ডেলিভারি সুবিধা পাওয়া যায়, যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয়।

আম উৎপাদনের পরিসংখ্যান

খুলনা বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর এই বিভাগে ৭,৮৯০ হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১,০৭,৯১৪ মেট্রিক টন। রাজশাহী বিভাগে ৯৩,১০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে, যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১১,০৫,৮৫৮ মেট্রিক টন। সম্ভাব্য বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ৭,০০০ কোটি টাকা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে ৪,৫০,০০০ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। সাতক্ষীরায় ৪,১৩৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে, যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬০,০০০ মেট্রিক টন। ইউরোপ ও আমেরিকায় ২০০ টন আম রপ্তানির আশা করা হচ্ছে।

রপ্তানি সম্ভাবনা

সাতক্ষীরার আম ইউরোপের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও গোবিন্দভোগ আমের চাহিদা রয়েছে ইংল্যান্ড, সুইডেন, ইতালি ও ফ্রান্সে। চলতি মৌসুমে ৩০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত মৌসুমের তুলনায় ১৩০ টন বেশি।

অনলাইনে আম বিক্রির উত্থান বাংলাদেশের কৃষি ও অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রপ্তানি বাজারের সম্প্রসারণ এই খাতকে আরও সমৃদ্ধ করছে। তবে প্রতারণা রোধে সচেতনতা এবং মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button