বিশ্ব

অর্ধনগ্ন অবস্থায় চাকরিহারা শিক্ষকদের মিছিলে উত্তপ্ত কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থায় আবারও উত্তেজনার ছায়া। ২০১৬ সালের স্কুল শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী বাতিল করা প্যানেলের ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া হাজার হাজার ‘যোগ্য’ শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আজ কলকাতায় নজিরবিহীন এক বিক্ষোভ দেখা গেছে—অর্ধনগ্ন অবস্থায় মিছিল করেছেন চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা। রাজধানী শহর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র শিয়ালদহ থেকে রাজ্য সচিবালয় নবান্ন পর্যন্ত এই প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল ‘অধিকার মঞ্চ’ নামে একটি শিক্ষক সংগঠন।

নিয়োগ কেলেঙ্কারির পটভূমি

২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই অভিযোগ উঠেছিল স্বজনপ্রীতি, ঘুষ লেনদেন ও অনিয়মের। বিষয়টি আদালতে গড়ায় এবং দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, ২০১৬ সালের পুরো নিয়োগ প্যানেল অবৈধ। আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, বাতিল হওয়া প্যানেলের ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কেউই আর চাকরিতে বহাল থাকতে পারবেন না।

এই রায়ের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষণা করে, তারা নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং শুক্রবার (৩০ মে) একটি নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে। প্রশাসনের ভাষ্য, নতুন নিয়ম মেনে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে, যাতে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম না থাকে।

‘যোগ্য’ চাকরিচ্যুতদের ক্ষোভ

তবে এই নতুন বিজ্ঞপ্তি মানতে রাজি নন সেই ২৬ হাজারেরও বেশি চাকরি হারানো ‘যোগ্য’ প্রার্থী। তাদের অভিযোগ, তারা কঠোর পরিশ্রম করে নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং কয়েক বছর ধরে নিয়মিত শিক্ষকতা করছিলেন। এখন হঠাৎ আদালতের রায়ে তারা চাকরি হারালেও নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় তাদের আবার বসার প্রস্তাব অবিচারমূলক।

চাকরিচ্যুত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকেই এই নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ‘দ্বিতীয় শাস্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের বক্তব্য, “আমরা যোগ্য ছিলাম, নিয়ম মেনেই চাকরি পেয়েছিলাম। প্যানেলে অনিয়ম হয়েছে সেটা সরকারের ভুল, তার শাস্তি আমরা কেন পাবো?”

অর্ধনগ্ন প্রতিবাদ: প্রতীকি ‘নগ্নতা’র বার্তা

এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে আজকের অর্ধনগ্ন মিছিলে। ‘অধিকার মঞ্চ’ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, “সরকার ও আদালতের সিদ্ধান্ত আমাদের ‘নগ্ন’ করে দিয়েছে। আমরা কর্মহীন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, পরিবার নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। এই অবস্থাকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরতেই আমাদের এই অর্ধনগ্ন প্রতিবাদ।”

আজ শুক্রবার সকাল থেকেই শিয়ালদহ স্টেশন এলাকায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জড়ো হতে দেখা যায়। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, মুখে ছিল প্রতিবাদের শ্লোগান। অর্ধনগ্ন অবস্থায় তারা এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। ঘটনাস্থলে মুহূর্তেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশের কড়া অবস্থান ও সরকারের তৎপরতা

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই মিছিল নবান্ন পর্যন্ত যাওয়ার কথা থাকলেও রাজ্য সরকার আগেই পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক করে রেখেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে মিছিলের আগেই শিয়ালদহ এলাকায় পুলিশি মোতায়েন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি যাতে বেগতিক না হয়, সেজন্য মিছিলকারীদের ঘিরে ফেলে পুলিশ এবং একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটকও করা হয় বলে সূত্র জানায়।

এই ঘটনায় রাজ্য প্রশাসন যেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তেমনই বিরোধী দলগুলোও নানা মন্তব্য করছে। বিজেপি নেতারা এই পরিস্থিতিকে সরকারের ব্যর্থতা বলে দাবি করছেন। তারা বলছেন, “মমতা সরকার দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার যুবকের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছে। আজ এই লজ্জাজনক দৃশ্য তার ফলাফল।”

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

এখন প্রশ্ন উঠেছে—এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? নতুন নিয়োগ যদি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী চলেও, তাহলে পুরনো চাকরিচ্যুতদের কী হবে? এই নিয়ে সরকারের তরফে এখনো স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়নি। যদিও শিক্ষা দফতরের একাধিক কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন, চাকরি হারানো ‘যোগ্য’ প্রার্থীদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন প্যাকেজ বা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুনর্নিয়োগের চিন্তা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, আন্দোলনকারীরা অনড়। তারা চাইছেন কোনো ধরণের পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হোক।

উপসংহার

শিক্ষা একটি সমাজের ভিত্তি। আর সেই শিক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই শিক্ষক সমাজ যদি রাজপথে এসে অর্ধনগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হন—তা নিঃসন্দেহে প্রশাসন ও রাজনীতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও আদালতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে সমাধান খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক-সমাজের আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আগামী দিনগুলোতে এই ইস্যু আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে বলে অনুমান করছেন বিশ্লেষকরা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button