এলডিসির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকে প্রস্তুতি নিতে হবে

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে রয়েছে। এই উত্তরণ দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, রপ্তানি বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানো, ঋণের উচ্চ সুদহার, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত তৈরি পোশাক শিল্প এই উত্তরণের পর সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। এই প্রতিবেদনে এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ, বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি, এবং পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি তালিকায় রয়েছে। এই মর্যাদার কারণে দেশটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এই সুবিধাগুলো আর থাকবে না। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানি পণ্যে শুল্ক আরোপ হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের সামনে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- ডব্লিউটিওর সুবিধা হারানো: বর্তমানে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য উন্নত দেশে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পায়। এই সুবিধা হারানোর ফলে রপ্তানি ব্যয় বাড়বে এবং বাজারে প্রতিযোগিতার চাপ বৃদ্ধি পাবে।
- জিএসপি সুবিধার সমাপ্তি: ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলে পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক আরোপিত হবে, যা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করবে।
- দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ: উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নতুন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আলোচনা ও সমন্বয়ে দক্ষতার অভাব রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
- ঋণের ঝুঁকি বৃদ্ধি: এলডিসি উত্তরণের পর সহজশর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। বিদেশি ঋণের উচ্চ সুদহার পরিশোধ করতে হবে, যা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে।
বেসরকারি খাতের ভূমিকা
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি সেমিনারে বক্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার একা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য সচিব ড. মনজুর হোসেন বলেন, “সরকার ইতোমধ্যে তিনটি কমিটি গঠন করেছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। তবে বেসরকারি খাতকে নিজস্ব উদ্যোগে পরিবর্তনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।”
বেসরকারি খাতের প্রস্তুতির জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রয়োজন:
- রপ্তানি বহুমুখীকরণ: বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। এই একক নির্ভরতা কমাতে অন্যান্য শিল্প যেমন—আইসিটি, চামড়াজাত পণ্য, এবং কৃষিভিত্তিক পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হবে। এ জন্য এসব খাতে পোশাক শিল্পের মতো সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
- দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা: তরুণ প্রজন্মকে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক।
- পণ্যের ব্র্যান্ডিং ও গুণগত মান: রপ্তানি পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা এবং ব্র্যান্ডিংয়ে জোর দিতে হবে। এটি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহায়তা করবে।
- মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ): ভিয়েতনামের মতো দেশের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে হবে। এটি জিএসপি সুবিধা হারানোর পর বিকল্প পথ তৈরি করবে।
পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এই খাত থেকে রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগের ৮১ শতাংশ আসে। তবে, এলডিসি উত্তরণের পর এই খাতের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানো: ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক আরোপ হলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে, যা বাজারে প্রতিযোগিতার চাপ বাড়াবে।
- নারী শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস: পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে, যা নারীর ক্ষমতায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিআইডিএসের সেমিনারে বক্তারা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
- শ্রমিক অসন্তোষ ও অস্থিরতা: শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, বোনাস পরিশোধে বিলম্ব, এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করার কারণে এই খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
- অবকাঠামোগত সমস্যা: গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, উচ্চ শুল্ক, এবং ঋণের উচ্চ সুদহার এই খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে।
তবে, পোশাক শিল্পের সম্ভাবনাও কম নয়। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, “এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।” তিনি গ্যাপেক্সপো ২০২৫-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে পোশাক খাতের প্রসারে জোর দিয়েছেন।
সরকারের উদ্যোগ ও সুপারিশ
সরকার ইতোমধ্যে এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতির জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে:
- কমিটি গঠন: তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা উত্তরণ-পরবর্তী কৌশল নির্ধারণে কাজ করছে।
- এফটিএ আলোচনা: বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চলছে। তবে, এ ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
- প্রণোদনার বিকল্প: নগদ সহায়তার পরিবর্তে রপ্তানি খাতে বিদ্যুৎ বিলে রেয়াত দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, এটি ডব্লিউটিওর নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান কাঠামোর সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণের কোনো বিকল্প নেই।” তিনি উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
টেকসই অর্থনীতির পথে
বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু পোশাক খাতের উপর নির্ভর করে টেকসই হতে পারবে না। বিআইডিএসের সেমিনারে বক্তারা বলেন, শিল্প খাত বৈষম্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি কমছে। ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান ৫২.৯ শতাংশ থেকে কমে ৩৮.৫ শতাংশ হয়েছে, যেখানে বৃহৎ শিল্পের অবদান বেড়ে ৬১.৫ শতাংশ হয়েছে।
টেকসই অর্থনীতির জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, এবং সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বলেন, “রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে রপ্তানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে। দেশীয় বাজারে বিক্রি রপ্তানির চেয়ে বেশি লাভজনক হওয়ায় উদ্যোক্তারা রপ্তানির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন।”
উপসংহার
এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলেও, এর সঙ্গে জড়িত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পোশাক শিল্পের উপর অতি-নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এখন সময়ের দাবি। বেসরকারি খাতকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।