বানিজ্য

বাজেটে কমছে ১৩৫ পণ্যের শুল্ক

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে দেশের শুল্ক ও কর কাঠামোয়। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শ, এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে এ বাজেটে নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৩৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, ৩১টি শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা বাতিল এবং আইটি খাতকে করের আওতায় আনা।

এছাড়া নতুনভাবে জুলাই আন্দোলনে আহতদের কর ছাড়ের আওতায় আনা, সাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধা শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো, উচ্চবিত্তের জন্য কর স্ল্যাব কঠোরকরণসহ অন্যান্য খাতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

১৩৫টি পণ্যের শুল্ক হ্রাস

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের রপ্তানি বাজারের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো এবং আমদানি পণ্যের উপর চাপ কমাতে ১৩৫টি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে। পাশাপাশি ৩০০টির বেশি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা হচ্ছে। মূলত যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় না, সেইসব মধ্যবর্তী ও শিল্পের জন্য অপরিহার্য কাঁচামাল এই শুল্ক কমানোর তালিকায় রয়েছে।

শুল্ক কাঠামোয় নতুন স্তর

বর্তমানে শুল্ক কাঠামোয় ৬টি স্তর রয়েছে (০%, ১%, ৫%, ১০%, ১৫%, ২৫%)। নতুন বাজেটে এতে ৩% হারে একটি স্তর যোগ করে মোট ৭টি স্তর করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সম্পূরক শুল্ক স্তর ১২টি থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করা হবে।

এছাড়া খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ও তুলাসহ অন্যান্য মৌলিক শিল্প কাঁচামালের শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে, যাতে সাধারণ জনগণ ও কৃষিপ্রধান অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী সরকার আগামী অর্থবছর থেকে ৩১টি শিল্প খাতে বিদ্যমান কর অবকাশ সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে এসব খাতে ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে।

প্রস্তাবিত শিল্পগুলো হলো:
একটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্ট, কৃষি যন্ত্রপাতি, রাবার ল্যাটেক্স, ইলেকট্রনিক্স উপাদান, বায়ো ফার্টিলাইজার, বায়োটেক কৃষিপণ্য, আসবাবপত্র, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, এলইডি টিভি, মোবাইল ফোন, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং, টেক্সটাইল যন্ত্রপাতি, খেলনা উৎপাদন, রোবোটিক্স, এআই প্রযুক্তি, ন্যানোটেকনোলজি এবং এয়ারক্রাফট হেভি মেইনটেন্যান্স।

আইটি খাত করের আওতায়

আগামী বাজেটে প্রথমবারের মতো আইটি খাতকে সরাসরি করের আওতায় আনা হচ্ছে। এর আওতায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, কল সেন্টার, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ক্লাউড সার্ভিস, আইটি ফ্রিল্যান্সিং, সাইবার সিকিউরিটি, রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিংসহ প্রায় ২৫টির বেশি সেবা খাত করের আওতায় আসবে।

এই পরিবর্তনের ফলে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের আয় হিসাব করার সময় এসব সেবা খাত থেকে অর্জিত আয়ও আয়কর গণনার অন্তর্ভুক্ত হবে, যা আগে বাদ দেওয়া হতো।

করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি

আসন্ন বাজেটে সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই সীমা ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে।

জুলাইযোদ্ধাদের কর ছাড়

২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার এক গেজেটের মাধ্যমে জুলাই ১৯৭৪ গণআন্দোলনে আহত ১ হাজার ৪০১ জনকে ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাজেটে তাদের আয়করের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো করমুক্ত সীমা সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই সিদ্ধান্ত ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ওপর নতুন সীমা অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হবে।

উচ্চবিত্তদের কর কাঠামো কঠোর

এনবিআর চলতি বাজেটে উচ্চবিত্ত শ্রেণির ওপর বাড়তি কর আরোপ করতে যাচ্ছে। বর্তমানে যেসব করদাতার বার্ষিক আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি, তারা ৩০% হারে কর দেন। নতুন প্রস্তাবে এই সীমা ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে, যার ফলে এ শ্রেণির করদাতাদের বেশি কর দিতে হবে।

এইচএস কোড ভুলে জরিমানা কমানো

আমদানি-রপ্তানিকারকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভুল এইচএস কোড ঘোষণার ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানার হার কমানো হচ্ছে। বর্তমান আইনে এইচএস কোড ভুল বা মিথ্যা ঘোষণা করলে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানা করতে হয়।

নতুন প্রস্তাবে এ হার সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে, যাতে অনিচ্ছাকৃত ভুলে আমদানিকারকরা সর্বস্বান্ত না হন।

উপসংহার

আসন্ন বাজেটে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় কর ও শুল্ক কাঠামোয় যে পরিবর্তনগুলো আনতে যাচ্ছে, তা দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, আইএমএফের সুপারিশ এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে। তবে এসব পরিবর্তনের বাস্তব প্রয়োগ ও ফলাফল নির্ভর করবে সঠিক বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের ওপর।

এ ধরনের বাজেট সাধারণ জনগণ, ব্যবসায়ী এবং শিল্পখাতের জন্য যেমন কিছু স্বস্তির বার্তা আনবে, তেমনি কর কাঠামোয় পরিবর্তনের কারণে নতুন চ্যালেঞ্জও দেখা দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button