বিশ্ব

ইয়েমেনের সানা বিমানবন্দরে ফের ইসরায়েলি হামলা 

ব্যালিস্টিক হামলার জবাবে ইসরায়েলের পাল্টা আঘাত, উত্তপ্ত হচ্ছে আরব উপদ্বীপ

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও গভীর রূপ নিচ্ছে। হুতি বিদ্রোহীদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাবে ইয়েমেনের রাজধানী সানার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনিয়া এয়ারওয়েজের সর্বশেষ বেসামরিক বিমানটি।

আল জাজিরা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, হুতি-ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম আল মাসিরাহর বরাত দিয়ে জানা গেছে, সানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে চারটি ধারাবাহিক বোমা হামলা চালায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। বিমানবন্দরের পরিচালক খালেদ আল-শায়েফ বলেন,

“এই বিমান হামলা ছিল পরিকল্পিত, নির্দয় ও বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের ঘৃণ্য প্রয়াস।”

চার দফা হামলায় বিপর্যস্ত সানা বিমানবন্দর

বুধবার (২৮ মে) রাতে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী সানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারটি রানওয়েতে লক্ষ্য করে চার দফায় বোমা বর্ষণ করে। এতে বিধ্বস্ত হয় ইয়েমেনিয়ার শেষ ফ্লাইটটি, যার মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরত আসছিলেন চিকিৎসা নিতে যাওয়া কয়েকজন সাধারণ নাগরিক।

সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার, টার্মিনাল ভবন, ইমিগ্রেশন ডেস্ক ও কার্গো গুদামসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ?

হামলার একদিন আগে হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। যদিও ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে, তবে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র রামাত নেগেভ এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের কাছাকাছি বিস্ফোরিত হয়।

নেতানিয়াহু সরকার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, “যেখান থেকেই হামলা আসুক না কেন, আমরা জবাব দেব।” সানা বিমানবন্দরে এই বিমান হামলাকে সেই হুঁশিয়ারির বাস্তবায়ন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ধ্বংস হলো ইয়েমেনের ‘একমাত্র’ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সংযোগ

সানা বিমানবন্দর ইয়েমেনের একমাত্র বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির জনগণের জন্য এ ছিল বিশ্বে সংযোগের প্রধান পথ। গত দুই বছরে কেবল চিকিৎসা, শিক্ষার্থী ও প্রবাসী ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সীমিতভাবে বিমান চলাচল হয়েছিল।

ইয়েমেনিয়া এয়ারওয়েজের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমানে আর কোনো কর্মক্ষম বাণিজ্যিক বিমান তাদের বহরে নেই। এ ঘটনায় দেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

ইসরায়েলের আগ্রাসন নাকি আত্মরক্ষা?

নেতানিয়াহুর সরকার এই হামলাকে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ বলে দাবি করলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটিকে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে:

“ইসরায়েল বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে।”

জাতিসংঘের ইয়েমেনবিষয়ক দূত হ্যান্স গ্রান্ডবার্গ এক বিবৃতিতে বলেন,

“এই ধ্বংসসাধন শুধু একটি অবকাঠামো ধ্বংস নয়, এটি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতির জনগণের শেষ আশাও মুছে ফেলা।”

এর আগেও ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিমানবন্দর

গত এক বছরে ইসরায়েল একাধিকবার সানা বিমানবন্দরে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় ইয়েমেনিয়ার তিনটি বিমান ধ্বংস হয়। তখনও ইয়েমেন সরকার জাতিসংঘে অভিযোগ দিয়েছিল। কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, এই বারবার হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন নস্যাৎ করতে চাইলেও কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও মানবিক সেবা কার্যক্রম।

ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া

হুতিদের পৃষ্ঠপোষক ইরান এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেন,

“ইসরায়েলের এই বর্বরতা বন্ধ না হলে মধ্যপ্রাচ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়বে।”

অন্যদিকে সৌদি আরব, যারা সম্প্রতি হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ছিল, বলেছে,

“এই হামলা শান্তি প্রচেষ্টাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।”

বাংলাদেশের উদ্বেগ ও অবস্থান

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়:

“সানা বিমানবন্দরের মতো মানবিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী। বাংলাদেশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিপূর্ণ আলোচনার আহ্বান জানায়।”

মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ইয়েমেনে দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের পর এই বিমান হামলা মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত করবে। বর্তমানে সেখানে ২ কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেকই মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সানা বিমানবন্দর ছিল সেই সহায়তা প্রবেশের একটি প্রধান পথ।

জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button