আইপিএলে মানকাডিং বিতর্ক: রাঠীর চেষ্টায়ও আউট হলেন না জিতেশ

ভারতের জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লীগ আইপিএলে আবারও আলোচনায় ‘মানকাডিং’। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের স্পিনার দিগ্বেশ রাঠী এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ব্যাটসম্যান জিতেশ শর্মাকে মানকাডিংয়ের ফাঁদে ফেলেন। ব্যাটসম্যান তখন ক্রিজের বাইরে ছিলেন—তবুও তাঁকে আউট ঘোষণা করা হয়নি। কেন?
এই ঘটনা আইপিএলের ২০২৫ মৌসুমের কোয়ালিফায়ার নিশ্চিতকারী ম্যাচে ঘটে, যা ইতিমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। দর্শকদের একাংশ বিষয়টি নিয়ে বিস্মিত, কেউ কেউ আবার রাঠীর ‘স্পোর্টসম্যানশিপ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে?
ম্যাচের ১৭তম ওভারে, স্পিনার দিগ্বেশ রাঠী ডেলিভারির ঠিক আগমুহূর্তে থেমে যান এবং বল না করে সরাসরি নন-স্ট্রাইকার এন্ডের স্টাম্প ভেঙে দেন। সেসময় বেঙ্গালুরুর ব্যাটসম্যান জিতেশ শর্মা ক্রিজের বাইরে ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, একে বলা হয় ‘রানআউট বাই বোলার বিফোর ডেলিভারি’—যা ক্রিকেট বিশ্বে সাধারণভাবে ‘মানকাডিং’ নামে পরিচিত।
তবে আম্পায়ার উলহাস গান্ধে বিষয়টি থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠান। রিপ্লে দেখে দেখা যায়, রাঠী বল ছাড়ার সময় পার করে গিয়েছিলেন এবং তখনই স্টাম্প ভেঙেছেন। এর ফলেই থার্ড আম্পায়ার ‘নট আউট’ ঘোষণা করেন।
আইসিসি ও আইপিএলের নিয়ম কী বলে?
আইপিএলের ‘প্লেয়িং কন্ডিশন ৩৮.৩.১’ অনুযায়ী:
“যদি বোলার ডেলিভারির আগে, যখন তিনি বল ছাড়ার পর্যায়ে পৌঁছাননি, তখন ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যান—তাহলে বোলার তাঁকে রানআউট করতে পারেন।”
কিন্তু এই ক্ষেত্রে দিগ্বেশ রাঠী তার বল ছাড়ার অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। বল ছোড়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর যদি নন-স্ট্রাইকার ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং বোলার স্টাম্প ভাঙেন, তবুও এটি রানআউট হিসেবে গণ্য হবে না। এক্ষেত্রে বল ডেলিভারি ধরা হয়, এবং নিয়ম অনুযায়ী এটি তখন বৈধ রানআউট নয়।
পন্তের ভূমিকা ও খেলার সৌন্দর্য
এখানে লক্ষ করার মতো একটি দৃষ্টান্তমূলক দিক হলো লক্ষ্ণৌ অধিনায়ক ঋষভ পন্তের ভূমিকা। যখন থার্ড আম্পায়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, তখন পন্ত ইশারায় জানিয়ে দেন, তিনি এই আপিল তুলে নিচ্ছেন। এমনকি এরপর জিতেশ শর্মার সঙ্গে কোলাকুলিও করেন তিনি।
পন্ত পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জানান, “এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্মান বজায় রাখা জরুরি। আমি চাইনি এমনভাবে উইকেট আসুক।”
ক্রিকেটবিশ্বে এই আচরণ প্রশংসিত হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, পন্ত খেলাটির ‘জেন্টলম্যান’ বৈশিষ্ট্যকেই সামনে এনেছেন।
ম্যাচের মোড় ঘোরানো ইনিংস
জিতেশ শর্মা ওই ম্যাচে ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। প্রথমে রাঠীর বলে আউট হলেও সেটি ‘নো বল’ হওয়ায় বেঁচে যান। এরপর তিনি মাত্র ৩৩ বলে ৮৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন, যেখানে ছিল ৮টি চার এবং ৬টি ছয়। তার এই ইনিংসই বেঙ্গালুরুকে লক্ষ্ণৌয়ের ২২৮ রানের বিশাল লক্ষ্য ছুঁতে সহায়তা করে এবং কোয়ালিফায়ারে জায়গা নিশ্চিত করে।
বেঙ্গালুরুর পরবর্তী প্রতিপক্ষ হবে পাঞ্জাব কিংস, ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ২৯ মে।
মানকাডিং: বিতর্ক নাকি কৌশল?
‘মানকাডিং’ শব্দটি এসেছে ভারতের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ভিনু মানকাডের নাম থেকে। ১৯৪৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিল ব্রাউনকে একই কায়দায় আউট করেছিলেন তিনি। সেই থেকে এই কৌশলকে বলা হয় ‘মানকাডিং’। যদিও আইসিসি এই নিয়মকে বৈধ ঘোষণা করেছে, তবুও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক কখনোই থামে না।
অনেকে মনে করেন, এটি ক্রিকেটের স্পোর্টসম্যানশিপের পরিপন্থী। আবার অন্য একটি পক্ষ বলছেন, যখন ব্যাটসম্যান নিয়ম ভাঙেন (যেমন ডেলিভারির আগেই ক্রিজ ছেড়ে বের হওয়া), তখন বোলারের অধিকার আছে তাঁকে আউট করার।
বিশ্ব ক্রিকেটে সাম্প্রতিক মানকাডিং বিতর্ক
১. দীপতি শর্মা বনাম চার্লি ডিন (২০২২): ভারত-ইংল্যান্ড নারী ওয়ানডে ম্যাচে দীপ্তি শর্মা মানকাডিং করে চার্লি ডিনকে আউট করেন। সে সময় বিষয়টি ঘিরে বিতর্ক ছড়িয়েছিল গোটা ক্রিকেট দুনিয়ায়।
২. জস বাটলার বনাম আশ্বিন (২০১৯ আইপিএল): রাজস্থান রয়্যালসের জস বাটলারকে মানকাডিং করে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন রবিচন্দ্রন আশ্বিন। পরবর্তীতে আইসিসি এই আউটকে বৈধ বললেও ক্রিকেট দুনিয়া বিভক্ত হয়ে পড়ে।
রাঠী কী ভুল করলেন?
রাঠী মূলত তার বোলিং অ্যাকশন সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন এবং এরপর স্টাম্প ভাঙেন। এই সময়ের মধ্যে যদি ব্যাটসম্যান ক্রিজের বাইরে থাকেন, তবুও আইসিসি নিয়ম অনুযায়ী তিনি নট আউট থাকবেন। ফলে, যেহেতু তিনি বল ছাড়ার পর্যায় অতিক্রম করেছিলেন, তাই সিদ্ধান্ত ছিল যথার্থ।
নিয়ম জানাই শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা
ক্রিকেট শুধু বল আর ব্যাটের খেলা নয়, এটি নিয়ম, কৌশল এবং নৈতিকতার একটি মিশ্রণ। দিগ্বেশ রাঠীর মানকাডিং চেষ্টায় হয়তো উইকেট আসেনি, কিন্তু নিয়মের সূক্ষ্মতা এখানে চোখে পড়েছে। আর ঋষভ পন্তের আপিল তুলে নেওয়ার মাধ্যমে খেলাটির সৌন্দর্যও ফুটে উঠেছে।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্রিকেটভক্তরা শুধু উত্তেজনার রস পেয়েছেন না, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন।