অর্থনীতি

এখন মাথাপিছু আয় ২,৮২০ ডলার, যা যাবৎকালের সর্বোচ্চ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে দেশের মাথাপিছু আয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২০ মার্কিন ডলার, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরের তুলনায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৮২ ডলার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) আজ মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, গত অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৩৮ ডলার। ২০২৪-২৫ সালে তা বেড়ে ২ হাজার ৮২০ ডলারে পৌঁছেছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৯৩ ডলার, যা এবার ছাড়িয়ে গেল।

টাকার অঙ্কে মাথাপিছু আয় কত?

ডলারের বিপরীতে টাকার মান বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২২১ টাকা। গত অর্থবছরে তা ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ১০২ টাকা। অর্থাৎ, টাকার অঙ্কেও এক লাফে মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা।

কেন এই রেকর্ড বৃদ্ধির পেছনে ডলারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ?

মাথাপিছু আয়ের এই বৃদ্ধি মূলত টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ডলার হিসেবে বেশ খানিকটা সীমিত ছিল গত কয়েক বছর। ডলারের গড় বিনিময় হার বাড়ায় আগে যত আয় হতো, তা ডলারে কম দেখাত। এবারও বিবিএস গড় ডলার রেট হিসেব করেছে প্রতি ডলার = ১২০ টাকা ২৯ পয়সা হারে, যেখানে গত বছর ছিল ১১১ টাকা ৬ পয়সা। ডলারের দামের এই পার্থক্য মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও প্রভাব ফেলেছে।

মাথাপিছু আয় কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?

মাথাপিছু আয় (Per Capita Income) হচ্ছে দেশের মোট জাতীয় আয়কে জনসংখ্যার ওপর ভাগ করে পাওয়া গড় আয়। এটি ব্যক্তিগত আয় নয়, বরং দেশের সার্বিক আয় ও অর্থনৈতিক অবস্থার একটি নির্দেশক। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) ছাড়াও প্রবাসী আয়, বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়।

বিগত অর্থবছরগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা:

অর্থবছরমাথাপিছু আয় (ডলার)
২০২১-২২২৭৯৩
২০২২-২৩২৭৪৯
২০২৩-২৪২৭৩৮
২০২৪-২৫২৮২০

উপরের তালিকা থেকে স্পষ্ট, ২০২১-২২ সালের পর থেকে মাথাপিছু আয়ে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিলেও চলতি অর্থবছরে তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মাথাপিছু আয়ের এই রেকর্ড বৃদ্ধির পেছনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের উন্নয়ন অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক শিল্পে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ফলে জাতীয় আয় বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক বলেন,

“মাথাপিছু আয় বাড়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ইঙ্গিত। তবে আমাদের দেখতে হবে এই আয় কতটা সুষমভাবে বিতরণ হচ্ছে। আয় বৈষম্য কমাতে না পারলে এই সংখ্যা উন্নয়নকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে না।”

তরুণ জনগোষ্ঠী ও রেমিট্যান্স: আয়ের মূল চালিকা শক্তি

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ, যারা কর্মক্ষম এবং প্রবাসে কাজ করছে। গত অর্থবছরে প্রবাসী আয় আবারও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশে অভিবাসী বাংলাদেশিরা বেশি আয় করছেন। এই রেমিট্যান্সই জাতীয় আয়ের বড় একটি অংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮.৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৭.৫ শতাংশ বেশি।

সতর্ক দিক: উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি

যদিও মাথাপিছু আয় বাড়ছে, তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলারের ঘাটতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারছে না বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। অনেক ক্ষেত্রে আয় বাড়লেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তা কার্যত নাগরিকদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, “মাথাপিছু আয়ের সাথে সাথে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। না হলে জাতীয় আয়ের এই বৃদ্ধি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।”

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২,৮২০ ডলারে পৌঁছানো নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। তবে এই উন্নয়ন যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে এর সুফল পৌঁছায়, সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আয় বৈষম্য দূর করে সুষম উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button