মমতাজের দিকে আবার ডিম নিক্ষেপ, আদালতে হাজিরা শেষে রিমান্ডে

গায়িকা ও সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমকে কেন্দ্র করে মানিকগঞ্জে উত্তেজনা আবারও চরমে পৌঁছেছে। হত্যা মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে আবারও তাঁকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়েন বিএনপিপন্থী ওলামা দলের নেতা-কর্মীরা। পুলিশি নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও আদালত চত্বরে ঘটে এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
একই দিনে আদালত শুনানি শেষে তাঁকে দুই দিনের রিমান্ডে হরিরামপুর থানায় নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে তিনি দুটি মামলার রিমান্ডে রয়েছেন—একটি হত্যা মামলা এবং অপরটি হামলা ও ভাঙচুর সংক্রান্ত মামলা।
আদালতে হাজিরা ও রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা
মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল সাড়ে আটটায় কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে মমতাজকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাঁকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয় এবং বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরীর আদালতে তোলা হয়।
সিঙ্গাইর থানায় করা হত্যা মামলার শুনানি শেষে আদালত হরিরামপুর থানায় দায়ের হওয়া হামলা ও ভাঙচুর মামলায় আগে অনুমোদিত দুই দিনের রিমান্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী দুপুরে তাঁকে প্রিজন ভ্যানে করে হরিরামপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আবারও ডিম নিক্ষেপ, কড়া নিরাপত্তায়ও বন্ধ হলো না হামলা
এই দিনেই আদালত চত্বরে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হয়ে মমতাজ বেগমকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ করেন। যদিও আদালত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন ছিল, তথাপি বিক্ষোভকারীরা সুযোগ পেয়ে মমতাজের দিকে ডিম ছুঁড়ে দেন এবং সরকারবিরোধী স্লোগানও দেন।
গত ২২ মে আদালতে হাজিরার সময়েও একইভাবে মমতাজকে লক্ষ্য করে ডিম ও জুতা ছোড়া হয়েছিল। সেবারও ঘটনার মূল কেন্দ্র ছিল আদালত চত্বর।
হত্যা মামলার পটভূমি: ২০১৩ সালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা
মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হত্যা মামলাটি দীর্ঘ ১২ বছর আগের একটি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হরতালের সমর্থনে মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর সড়কের গোবিন্দল নতুন বাজার এলাকায় ইসলামী সমমনা দলের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করেন।
এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চারজন নিহত হন—নাজিম উদ্দিন মোল্লা, মাওলানা নাসির উদ্দিন, আলমগীর হোসেন এবং শাহ আলম। নিহতদের মধ্যে বাদী মজনু মোল্লার ছেলে নাজিমও ছিলেন। প্রায় এক দশক পর, গত বছরের ২৫ অক্টোবর গোবিন্দল গ্রামের মো. মজনু মোল্লা বাদী হয়ে সিঙ্গাইর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন, যাতে মমতাজ বেগমকে প্রধান আসামি করা হয়।
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১০৯ জন নেতা-কর্মী ওই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
ভাঙচুর ও হামলার মামলার বিবরণ
অন্যদিকে ২০২২ সালের ৩০ মে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে হরিরামপুর উপজেলার বয়ড়া গ্রামে জেলা বিএনপির উদ্যোগে দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়। সেখানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বক্তব্য চলাকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় আফরোজা খানের বসতবাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
পরে ২৯ অক্টোবর হরিরামপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে হরিরামপুর থানায় মামলা করেন। মামলায় মমতাজকে প্রধান আসামি করে ৮৬ জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।
পুলিশের বক্তব্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সিঙ্গাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌফিক আজম জানান, “হত্যা মামলার নির্ধারিত শুনানির জন্য মমতাজ বেগমকে আদালতে আনা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁকে হরিরামপুর থানায় নেওয়া হয়েছে। সেখানে দুই মামলার মোট ছয় দিনের রিমান্ড কার্যক্রম চলবে।”
তিনি আরও বলেন, “সিঙ্গাইর থানা এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় তাঁকে হরিরামপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও জনমত
এই ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। একদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলছে, অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা দাবি করছেন, “মমতাজ বেগম দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এলাকায় দমনপীড়ন চালিয়ে এসেছেন এবং এখন তার বিচার শুরু হয়েছে।”
অনেকেই বলছেন, ২০১৩ সালের ঘটনার বিচার দীর্ঘদিন বিলম্বিত হওয়ায় এ ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনের আগে মমতাজ বেগমকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার কৌশল হিসেবেও মামলা ও রিমান্ড ব্যবহৃত হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের আদালত চত্বরে আবারও সাবেক সাংসদ ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমকে কেন্দ্র করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে চলমান বিচারপ্রক্রিয়া, অন্যদিকে প্রকাশ্য আদালত এলাকায় হামলার ঘটনা—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা চলছে—একটি হত্যা, অপরটি হামলা ও ভাঙচুর সংক্রান্ত। এসব মামলার রায়ের মাধ্যমে হয়তো ভবিষ্যতে এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার জবাব মিলবে।