ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম হোসেনের হঠাৎ পদত্যাগ

হঠাৎ ৭ হাজার কোটি টাকার সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির প্রশ্ন, সিপিডির কটাক্ষ
সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য মহার্ঘ ভাতা প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, বর্তমান ৫ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনার পরিবর্তে এই মহার্ঘ ভাতা চালু করা হলে সরকারি ব্যয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। আর এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রশ্ন তুলেছে—“এটা কি সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করার উদ্যোগ?”
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আজ মঙ্গলবার (২৭ মে ২০২৫) এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেন, “এই ভাতা প্রদানের সময় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদি সাধারণ নাগরিকদের জন্য কোনো সহায়তা না থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতির চাপ তারা আর নিতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, এখন ৫ শতাংশ হারে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, তার বদলে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হবে বিশাল অঙ্কের। বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন দেশের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সিপিডির পর্যালোচনা: রাজস্ব ঘাটতি পৌঁছাতে পারে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা
সিপিডি জানায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের শেষ ১ মাসে (জুন মাস) লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ হতে হবে। যা প্রায় অসম্ভব বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি।
মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ফাহমিদা খাতুন জানান, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরে একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা আগের বছরের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে অনেক কম।
এনবিআরের সংস্কারে গতি বাড়ানোর পরামর্শ
সিপিডি মনে করে, এনবিআরের চলমান সংস্কার কার্যক্রম আরও জোরদার করা উচিত। ফাহমিদা খাতুন বলেন, “সংস্কার ছাড়া রাজস্ব প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।” তিনি সরকারের ব্যয় কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নির্দিষ্ট একটি শ্রেণিকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে জনসাধারণকে অবহেলা করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে আর্থিক খাতে বড় চমক: ব্র্যাক ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ
এই আলোচনার মধ্যেই আর্থিক খাতের আরেকটি বড় খবর এসেছে—ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও সেলিম আর এফ হোসেন পদত্যাগ করেছেন।
সোমবার (২৭ মে) ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি এবং পর্ষদ তা গ্রহণ করেছে। এখন কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষা।
সেলিম আর এফ হোসেন ২০১৫ সালের নভেম্বরে ব্র্যাক ব্যাংকের নেতৃত্বে আসেন। বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব বাড়িয়ে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ থাকার কথা ছিল। তবে হঠাৎ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ মাস আগেই পদত্যাগ করলেন।
“আপাতত ছুটিতে যাচ্ছি”—সেলিম
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে তিনি বলেন, “আজ আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। এটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।” কোনো নতুন ব্যাংকে যোগ দিচ্ছেন কি না—এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আপাতত না। ছুটি কাটাব।”
ব্যাংকের কর্মীদের পাঠানো এক গ্রুপ ই-মেইলে তিনি বলেন, আজই তাঁর শেষ কর্মদিবস। এটি ব্যাংকটিতে নেতৃত্ব পরিবর্তনের একটি স্পষ্ট বার্তা।
ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন তারেক রেফাত
সেলিমের পদত্যাগের পর ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও করপোরেট অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান তারেক রেফাত উল্লাহ খান-কে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারেক রেফাত ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। ফলে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও স্থায়ীভাবে এই পদে পরিবর্তন আসবে কি না, তা নিয়ে ব্যাংক খাতের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এবিবি-তেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা
সেলিম আর এফ হোসেন বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর ২০২৪–২৫ মেয়াদের চেয়ারম্যান। তিনি পদত্যাগ করায় সেখানেও নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
দুই ঘটনার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত
এই দুই অর্থনৈতিক ঘটনার—সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণা ও বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার পদত্যাগ—বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
একদিকে, রাজস্ব ঘাটতির সম্ভাবনার মধ্যে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়াবে।
অন্যদিকে, একটি বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্বে হঠাৎ পরিবর্তন বিনিয়োগকারী এবং গ্রাহকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যখন ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীলতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজস্ব ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি এবং বেসরকারি খাতে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মতো ঘটনা একসঙ্গে সংঘটিত হওয়া একটি সংকেতবাহী বার্তা। সরকারকে একদিকে জনসাধারণের সুরক্ষা ও ভাতা নীতিতে ভারসাম্য রাখতে হবে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা করাও জরুরি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখনই সময় একটি সুসংহত ও স্বচ্ছ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল খাতকে একসূত্রে আনয়নের—যাতে দেশের উন্নয়ন যাত্রা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।