বানিজ্য

জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশ: বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর সফল ব্যবসা

গত ২৫ মে, রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে অনুষ্ঠিত অত্যাশ্চর্য এক অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশ। দেশের বিমান পরিবহন খাতের উন্নয়নে ও বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবসা সম্প্রসারণে এ ফোরাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশ্বাস দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া, টিএএস গ্রুপের পরিচালক মুজাক্কের হকসহ খ্যাতনামা জিএসএ উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। ভারত, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া মহাদেশের ৫০টির বেশি বিদেশি এয়ারলাইনসের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সুসংহত করতে দেশের ২৮টি জিএসএ কোম্পানি এখন এই প্ল্যাটফর্মের সদস্য।

জিএসএ কে এবং কেন যুক্তি

জিএসএ (General Sales Agent) বা বিক্রয় প্রতিনিধি হলো নির্দিষ্ট কোনো দেশের ভেতরে কোনও বিদেশি বিমান সংস্থার টিকিট বিক্রি, গ্রাহক সেবা, বিপণন ও ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি।

  • ব্যয়ের সুবিধা: সরাসরি নিজস্ব অফিস না খুলে জিএসএ নিয়োগ করায় বিমান সংস্থাগুলোর অবকাঠামো ও অপারেশনাল খরচ হ্রাস পায়।
  • লোকাল মার্কেটিং: স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও বাজার চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজড সেবা প্রদান সম্ভব হয়।
  • রিসোর্স শেয়ারিং: একাধিক বিমান সংস্থা একই জিএসএ’র মাধ্যমে সুবিধা নেয়, ফলে দক্ষতা বাড়ে ও ব্যবসার স্কেলিং সহজ হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৭০টির মতো বিদেশি বিমান সংস্থা স্থানীয় জিএসএ দের মাধ্যমে তাদের যাত্রী ও কার্গো সেবা পরিচালনা করছে। বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইনসের চাহিদা মেটাতে ২৮টি কোম্পানি এখন ফোরামের একীভূত নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে।

আনুষ্ঠানিক লোগো উন্মোচন ও প্রধান অতিথির বক্তব্য

অনুষ্ঠানে জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশের লোগো উন্মোচন করেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া। তাঁর ভাষ্য:

“বাংলাদেশের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি এয়ারলাইন্সের সেবা মান ও গ্রাহকসেবা উন্নত করতে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের প্ল্যাটফর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”

চেয়ারম্যান আরো বলেন, বাংলাদেশ এখন দক্ষ জনবল, বর্ধিত আন্তর্জাতিক রুট ও আধুনিক বন্দরের সুবিধা নিয়ে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এভিয়েশন হাব হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যোগ্য জিএসএ দের মাধ্যমে বিদেশি এয়ারলাইন্সকে আকর্ষণ করা জরুরি।

ফোরামের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পন

১. **নেটওয়ার্ক নির্মাণ:**国内 ও আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসের মধ্যকার তথ্য বিনিময়, ব্যবসায়িক সহযোগিতা ও যৌথ উদ্যোগের সুযোগ সৃষ্টি।
২. প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট: জিএসএ ও বিমান পরিবহন খাতের পেশাজীবীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন।
৩. গবেষণা ও ডেটা অ্যানালিটিক্স: স্থানীয় মার্কেট রিসার্চ, কাস্টমার বিহেভিয়র বিশ্লেষণ ও ট্রেন্ড রিপোর্ট তৈরি করে সদস্যদের শেয়ারিং।
৪. পলিসি এডভোকেসি: সরকার ও বেবিচককে এভিয়েশন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবনা ও নীতি সুপারিশ উপস্থাপন।
৫. ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং: বিশেষ প্রচারাভিযান, ওয়েবিনার ও ডিজিটাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিদেশি এয়ারলাইনসের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিতে সহায়তা।

ফোরামের আহ্বায়ক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ বলেন,

“আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের এ্যাভিয়েশন ইকোসিস্টেমকে আরও সজীব ও প্রতিযোগিতামূলক করা। দেশীয় জিএসএ দের দক্ষতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

বাংলাদেশের এভিয়েশন সেক্টরের সাম্প্রতিক গতিবিধি

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশি এভিয়েশন খাত উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দেখেছে:

  • নতুন রুট সংযোজন: ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর, দুবাই, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, মস্কোসহ ৩০টির অধিক গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু।
  • প্যাসেঞ্জার খাত বৃদ্ধি: বছরে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী বাংলাদেশের এয়ারপোর্ট ব্যবহার করছে।
  • কার্গো অপারেশন: বছরে ২.৫ লাখ টন কার্গো রপ্তানি-আমদানিতে এয়ারফ্রেইটের অংশীদারিত্ব।
  • বন্দরে উন্নয়ন: হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমান বন্দরে আধুনিক টার্মিনাল ও কার্গো সেন্টার নির্মাণ।
  • বেসরকারি এয়ারলাইন্স: উদ্ভাবনী ফ্লাইট সার্ভিসসহ নতুন সংস্থার প্রবেশ পাবে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে।

এসব প্রবৃদ্ধি স্থানীয় জিএসএ দের ভূমিকা ছাড়া সম্ভব হতো না, কারণ তারা গ্রাহক ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন তৈরি করে।

সদস্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া ও প্রত্যাশা

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সদস্য খালেদ ইউসুফ ফারাজী, আরিফ রহমান, মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ ডন, সোহাগ হোসেন সহ অন্যান্য উদ্যোক্তা।

  • খালেদ ইউসুফ ফারাজী: “একত্রিত হলে আমাদের দক্ষতা শেয়ার করার পাশাপাশি বড় প্রকল্প পরিচালনা সহজ হবে।”
  • আরিফ রহমান: “ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিতে জিএসএ গুলো আইডেন্টিফাই করে স্থানীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী কাস্টমাইজড সেবা দিতে পারে।”
  • সোহাগ হোসেন: “ফোরাম থেকে পাওয়া তথ্য ও নেটওয়ার্কিং আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে সহায়তা করবে।”

তারা আশা করছেন, আগামি কয়েক মাসে ফোরামে আরো ১৫-২০টি জিএসএ কোম্পানি যোগ দেবেন, যা ৭০টিরও বেশি এয়ারলাইন্সকে প্রতিনিধিত্ব করবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

১. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম: সদস্যদের ই-লার্নিং ও ভেরিফাইড রিসোর্স অ্যাক্সেসের জন্য অনলাইন পোর্টাল চালু।
২. বার্ষিক সম্মেলন: বিদেশি এয়ারলাইনস ও গভার্নমেন্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজন।
৩. ইকো-ফ্রেন্ডলি ইনিশিয়েটিভ: কার্বন নিরপেক্ষ এয়ারলাইন্স ব্র্যান্ডিং ও ‘গ্রীন’ ক্যাম্পেইন সমর্থন।
৪. ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিটি সার্টিফিকেশন: জিএসএ কোম্পানিগুলোর জন্য ISO ট্রেনিং ও সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম।

আজকের যুগে এরোহিঙ্কার সাথে তাল মিলিয়ে এভিয়েশন খাতকে টেকসই আর যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশ–র ভূমিকা অনস্বীকার্য। তথ্যভিত্তিক নীতি, প্রশিক্ষণ ও নেটওয়ার্কিং-এর মাধ্যমে তারা দেশের বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোকে দক্ষতার সাথে গ্রাহকের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। এতে দেশের পর্যটন, বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিমানের দুনিয়ায় বাংলাদেশ এখন সাফল্যের পথচলা শুরু করেছে, আর সেই পথচলার সঙ্গী হয়ে উঠতে যাচ্ছে জিএসএ ফোরাম অব বাংলাদেশ—একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও প্রগতিশীল প্ল্যাটফর্ম।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button