ইস্তাম্বুলে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী নেতার সঙ্গে এরদোয়ানের বৈঠক

ইস্তাম্বুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ২৪ মে শনিবার প্রেসিডেন্টের ইস্তাম্বুল কার্যালয়ে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই গোপনীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় এক নতুন শাসন কাঠামোর সূচনা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণে আলোচিত হচ্ছে।
হঠাৎ বৈঠক, পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই
বৈঠকটি ঘিরে শুরু থেকেই ছিল গোপনীয়তা। প্রেসিডেন্টদের মধ্যে আলোচনার খবর আগাম প্রকাশ করা হয়নি। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু’ এবং বেসরকারি চ্যানেল ‘এনটিভি’ জানায়, বৈঠকটি ইস্তাম্বুলের প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত হয় এবং তা প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী স্থায়ী হয়। আলোচনায় অংশ নেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, গোয়েন্দাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বিশ্লেষকদের মতে, বৈঠকের এই আকস্মিক আয়োজন বোঝায় যে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ পথরেখা নিয়ে তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
আসাদ পরবর্তী সিরিয়া: পরিবর্তনের হাওয়া
গত ডিসেম্বরে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিরিয়ার দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন আহমেদ আল-শারা। শারার নেতৃত্বাধীন নতুন প্রশাসন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়াকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আঙ্কারা শুরু থেকেই নতুন প্রশাসনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। গত কয়েক মাসে আঞ্চলিক বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে তুরস্কের কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে—তারা সিরিয়ার পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের কার্যালয়ের বাইরে দুই নেতাকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে দেখা যায়, যা রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন সৌহার্দ্যের ইঙ্গিত দেয়।
আলোচনার মূল বিষয়বস্তু
বৈঠকে তুরস্ক ও সিরিয়া একসঙ্গে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অঙ্গীকার করে। বিশেষ করে, উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি যোদ্ধাদের উপস্থিতি এবং জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আঙ্কারা বিদেশি কুর্দি যোদ্ধাদের বহিষ্কারের আহ্বান জানায় এবং আল-শারার সরকারকে এই বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
তুর্কি বার্তা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো:
- উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি গোষ্ঠীর কার্যক্রম
- সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিরাপত্তা বৃদ্ধির যৌথ উদ্যোগ
- সিরিয়া পুনর্গঠনে তুরস্কের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা
- আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যৌথ কৌশল
- মানবিক সহায়তা এবং উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসন
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা নতুন সিরিয়ার সঙ্গে একটি ইতিবাচক ও ভবিষ্যতমুখী সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা থাকবে।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আল-শারার প্রশাসনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এখনও পর্যন্ত আংশিক। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলতি মাসের শুরুতে সিরিয়ার ওপর থেকে কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, যা নতুন প্রশাসনের জন্য বড় কূটনৈতিক জয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তুরস্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলা নতুন নেতৃত্বের বৈধতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
এই বৈঠককে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। একদিকে রাশিয়া ও ইরান সাবেক শাসক আসাদের প্রতি এখনও আনুগত্য দেখিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের অংশবিশেষ নতুন নেতৃত্বকে সময় দিতে প্রস্তুত। এমন পরিস্থিতিতে তুরস্কের এই পদক্ষেপ সিরিয়াকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির পথে নিয়ে যেতে পারে।
মানবিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার দিক
বৈঠকে সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনে তুরস্কের কারিগরি সহায়তা ও বিনিয়োগ সম্ভাবনার বিষয়েও আলোচনা হয়। আলেপ্পো, হোমস এবং দেইর ইজোরে হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও স্কুল নির্মাণে যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব তোলা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই পক্ষ সম্মত হয়।
কূটনৈতিক পুনর্গঠনের পথে সিরিয়া
আল-শারার নেতৃত্বে সিরিয়া এখন কূটনৈতিকভাবে পুনঃসংযুক্ত হওয়ার পথে। আরব লীগের সদস্যপদ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ যেমন সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। তুরস্কের সঙ্গে এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক সিরিয়ার কূটনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান উলুই বলেন, “এই বৈঠক শুধু দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নয়, বরং সিরিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে আল-শারার নেতৃত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার একটি বড় ইঙ্গিত।”
উপসংহার
তুরস্ক ও সিরিয়ার এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুধুমাত্র রাজনৈতিক কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি একদিকে সিরিয়ার পুনর্গঠন, অন্যদিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একটি বড় পদক্ষেপ। এরদোয়ান ও আল-শারার এই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
পরবর্তী সময়ে এই আলোচনার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক চুক্তি, যৌথ নিরাপত্তা অভিযানে সহযোগিতা এবং শরণার্থী সংকট সমাধানে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।