বিশ্ব

গাজার ৭৭ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ইসরায়েল

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও অবরোধের ফলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে অব্যাহতভাবে চলছে তীব্র সংঘাত। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার যে পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের সাম্প্রতিক বিবৃতি অনুযায়ী, উপত্যকাটির প্রায় ৭৭ শতাংশ এলাকা এখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে ফিলিস্তিনিরা উপত্যকার একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন, যেখানে অবিরাম হামলা, অনাহার এবং বাস্তুচ্যুতির কারণে তাঁদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে।

সামরিক অভিযান ও অবরোধ: গাজার বর্তমান চিত্র

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে আসছে। গাজার জনসংযোগ কার্যালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী বেসামরিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতে সরাসরি স্থল অভিযান চালাচ্ছে এবং দখলদার বাহিনী মোতায়েন করছে। এর ফলে গাজার ৭৭ শতাংশ ভূখণ্ড তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের হয় চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, নয়তো তাঁদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে। ফলে বাসিন্দারা নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারছেন না, এবং তাঁদের জীবনযাত্রা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে।

গতকাল, ২৫ মে ২০২৫, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস, উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়া এবং মধ্য গাজার নুসেইরাতে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আশরাফ আবু নার নামে একজন সাংবাদিক। এই হামলাগুলো গাজার সাধারণ মানুষের জীবনে আরও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সংঘাত শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৪,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া, প্রায় ১,২৩,০০০ মানুষ আহত হয়েছেন।

ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা: জাতিগত নিধনের অভিযোগ

গাজার জনসংযোগ কার্যালয় তাদের বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে। তারা বলছে, ইসরায়েলের চলমান অভিযানগুলো জাতিগত নিধন, উপনিবেশবাদ এবং আগ্রাসনের প্রমাণ বহন করে। আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ইসরায়েল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে গাজায় একটি ‘চূড়ান্ত সমাধান’ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দখলদারি বন্ধের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

গাজার বাসিন্দারা কেবল যুদ্ধের ভয়াবহতার মুখোমুখি নন, তাঁরা চরম খাদ্য সংকট এবং মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে বসবাস করছেন। অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং জ্বালানির সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে, গাজার ২০ লাখের বেশি বাসিন্দার মধ্যে অধিকাংশই এখন বাস্তুচ্যুত। তাঁরা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন।

ইসরায়েলের পরিকল্পনা: ‘পুরো গাজা নিয়ন্ত্রণ’

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার বলে আসছেন যে, তাঁর সরকার গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে একযোগে অভিযান চালাচ্ছে। সামরিক অভিযানের পাশাপাশি তারা গাজার অবকাঠামো ধ্বংস করছে, যার মধ্যে রয়েছে স্কুল, হাসপাতাল এবং আবাসিক ভবন। গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ইসরায়েল গাজাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে চাইছে।

এদিকে, ইসরায়েলি হামলার শিকার হচ্ছেন গাজার সাংবাদিকরাও। গতকাল নিহত সাংবাদিক আশরাফ আবু নারের মৃত্যুতে গাজায় সংবাদ সংগ্রহের কাজ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠনগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হামলার অভিযোগ তুলেছে। ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় শতাধিক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা: সমালোচনা ও আহ্বান

গাজার জনসংযোগ কার্যালয় এবং ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, ইসরায়েলের এই আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জেনেভা কনভেনশন এবং অন্যান্য মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা এবং তাঁদের বাসস্থান ধ্বংস করা যুদ্ধাপরাধ। তবুও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং পশ্চিমা দেশগুলো এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে পাস হয়নি। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারা বলছে, ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন এই সংঘাতকে আরও উসকে দিচ্ছে।

মানবিক সংকট: গাজার ভবিষ্যৎ

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমশ অমানবিক হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৮৫ শতাংশ বাসিন্দা এখন বাস্তুচ্যুত। তাঁদের মধ্যে অনেকেই খোলা আকাশের নিচে বা অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছেন। শীতের মৌসুমে তাঁদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এ ছাড়া, খাদ্য ও পানির সংকটের কারণে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করলেও ইসরায়েলি অবরোধের কারণে তা অত্যন্ত সীমিত। মিশরের সীমান্তবর্তী রাফাহ ক্রসিং বন্ধ থাকায় ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো প্রবেশ করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে গাজার বাসিন্দারা ক্রমশ হতাশার দিকে ধাবিত হচ্ছেন।

উপসংহার

গাজার বর্তমান সংকট শুধু একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং অবরোধের ফলে গাজার ফিলিস্তিনিরা অমানবিক দুর্দশার মধ্যে বসবাস করছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা এই সংকটকে আরও গভীর করছে। গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের আহ্বান এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বিবেচনা করে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button