আন্তর্জাতিক সনদের অভাবে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না

চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচিত হলেও আন্তর্জাতিক সনদ ও পর্যাপ্ত কমপ্লায়েন্স না থাকায় এ খাত তার পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না। এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পে রফতানি, কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজনের বিরাট সুযোগ রয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুসরণে ঘাটতির কারণে এই খাত পিছিয়ে পড়েছে।
রোববার (২৫ মে) ডিসিসিআই আয়োজিত ‘চামড়া শিল্পের কৌশল নির্ধারণ: এলডিসি পরবর্তী সময়ে টেকসই রফতানি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
চামড়া খাতের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
তাসকীন আহমেদ জানান, তৈরি পোশাক খাতের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত হিসেবে চামড়া শিল্পের অবস্থান থাকলেও বৈশ্বিক বাজারে এর অংশীদারিত্ব মাত্র ১ শতাংশেরও কম। এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) মর্যাদা হারানোর পর আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া শিল্পের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। তাই সময় থাকতেই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, “আমরা চামড়া খাতে কাঙ্খিত অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সনদ যেমন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট না থাকা, পরিবেশগত মান বজায় রাখতে ব্যর্থতা এবং প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার।”
সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, “শিল্প মন্ত্রণালয় চামড়া খাতে নীতিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যাতে করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়। কিন্তু শুধু নীতি দিয়ে হবে না, বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতেও সকল স্টেকহোল্ডারকে একযোগে কাজ করতে হবে।”
তিনি জানান, শিল্প মন্ত্রণালয় বর্তমানে একটি ইকোসিস্টেম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে যা প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ সুরক্ষা, কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়নের উপর ভিত্তি করে কাজ করবে।
সিইটিপি’র সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “চামড়া খাতে পরিবেশ সংরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি)। কিন্তু সাভারের সিইটিপি’র বর্তমান সক্ষমতা ১৪ হাজার কিউবিক মিটার, যেখানে কোরবানির সময় চাহিদা হয় ৩২-৩৫ হাজার কিউবিক মিটার।”
তিনি জানান, একটি টেকনিক্যাল টিম বর্তমানে সিইটিপি’র সক্ষমতা ২০-২৫ হাজার কিউবিক মিটারে উন্নীত করতে কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে ৬টি প্রতিষ্ঠানকে সিইটিপি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং আরও ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলমান।
আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনের গুরুত্ব
এফবিসিসিআই’র প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “চামড়া শিল্পে এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছি না। এর ফলে আমরা ভালো দামে পণ্য বিক্রি করতে পারছি না এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “সিইটিপি কার্যকর থাকলে সম্মিলিতভাবে ব্যয় কমবে এবং মনিটরিং সহজ হবে। পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে সার্টিফিকেট পাওয়া সহজ হবে।”
শিল্প নগরীর অচলাবস্থার পর্যালোচনা
লেদার গুডস্ অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধে বলেন, “হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তর করা হলেও এখনও পর্যন্ত সিইটিপি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয়নি। এর ফলে রফতানিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “চামড়া শিল্প বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় উন্নয়ন কাঙ্খিত গতিতে হচ্ছে না। একে একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা সময়ের দাবি।”
রফতানি প্রবৃদ্ধির পথ খুঁজে পাওয়ার আহ্বান
নাসিম মঞ্জুর বলেন, “যদি এ খাতে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দেওয়া হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া রফতানি ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো সম্ভব। এমনকি ২০৩৫ সালে তা ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।”
তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ক্লাইমেট ফাইন্যান্স ফান্ড থেকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থার দাবিও জানান।
উদ্যোক্তাদের মতামত ও প্রস্তাব
সভায় অংশ নেওয়া উদ্যোক্তারা চামড়া শিল্পের সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। জেনিস সুজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির খান বলেন, “সাপ্লাই চেইন দুর্বল, কাস্টমস জটিলতা রয়েছে। এসব সমাধান করলে রফতানি বাড়ানো সম্ভব।”
অস্টান লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা বলেন, “আমাদের কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। দীর্ঘ আমদানি প্রক্রিয়ার কারণে লিড টাইম বেড়ে যায়, এতে বিদেশি ক্রেতা হারাচ্ছি।”
বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান বলেন, “বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব ইটিপি স্থাপনে এগিয়ে আসতে হবে। ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সিইটিপি ব্যবহারে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, “এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিবেশ ও শ্রম খাতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে।”
বিডার মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক বলেন, “আমাদের অর্থনীতি আগামী ১৫ বছরে দ্বিগুণ হতে পারে। এজন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় দরকার।”
তিনি আরও জানান, বিডা সম্প্রতি একটি ‘হিটম্যাপ’ তৈরি করেছে, যেখানে চামড়া খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এবং এই খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ চলছে।
সারসংক্ষেপ ও প্রস্তাবনা
মতবিনিময় সভায় স্পষ্ট হয়েছে, চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা বিশাল হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন:
- আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনের লক্ষ্যে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ
- সিইটিপি’র সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কার্যকর বাস্তবায়ন
- প্রযুক্তি ও ভ্যালুচেইন উন্নয়ন
- সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়
- স্বল্প সুদে ঋণের সুযোগ ও নীতি সহায়তা
ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ সভার শেষদিকে কোরবানির পশুর চামড়ার সঠিক মূল্য নির্ধারণের ওপর জোর দেন, কারণ তা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত।
চামড়া শিল্পে সম্ভাবনা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পেতে হলে এখনই সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার। তা না হলে এই শিল্প ধীরে ধীরে আরও পিছিয়ে পড়বে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়।