জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লায় নজরুল জন্মবার্ষিকীর তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লায় শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। ২৫ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত চলবে এই জাতীয় অনুষ্ঠান, যা শুধু কুমিল্লার নয়, গোটা দেশের সাহিত্যপ্রেমী ও সংস্কৃতিসচেতন মানুষের জন্য এক গভীর আবেগ ও গৌরবের উপলক্ষ।
‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত এ উৎসবে অংশ নিচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, কবিপরিবারের সদস্য এবং দুইজন জাতীয় উপদেষ্টা।
নজরুল ও কুমিল্লার আত্মিক সম্পর্ক
যদিও নজরুলের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে, তবুও তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল কুমিল্লায়। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পাঁচবারে মোট ১১ মাস তিনি কুমিল্লায় অবস্থান করেন। এই শহরের ধর্মসাগর পাড়, কান্দিরপাড়, দারোগাবাড়ি, রাণীর দীঘির পাড়, মহেশাঙ্গন এবং নবাববাড়িসহ অসংখ্য স্থানে কবির পদচারণা তাঁকে বিদ্রোহী থেকে প্রেমিক কবিতে রূপান্তরিত করে।
এই শহরেই নজরুল প্রেমে পড়েন নার্গিস আসার খানম এবং পরবর্তীতে প্রমীলা দেবীর। এখানেই তিনি গানে, কবিতায়, নাটকে নিজেকে মেলে ধরেন এক শিল্পীরূপে।
১২৬তম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে নতুন প্রাণ
নজরুলের এই নিবিড় সম্পর্ককে স্মরণ করে এবার কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায়। অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করছে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন।
- ২৫ মে: উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। প্রধান অতিথি সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মো. লতিফুল ইসলাম শিবলী এবং কবিপৌত্রী খিলখিল কাজী।
- ২৬ মে: অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে, যেখানে কবি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।
- ২৭ মে: সমাপনী অনুষ্ঠান হবে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। প্রধান অতিথি থাকবেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
স্মৃতি সংরক্ষণে স্থানীয়দের দাবি
নজরুলের কুমিল্লা-অধ্যায়ের অসংখ্য নিদর্শন আজও কালের সাক্ষ্য বহন করছে। তবে সংরক্ষণের অভাবে অনেক স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হওয়ার পথে। যেমন—
- দৌলতপুরের সেই আমগাছ, যার নিচে বসে নজরুল গান লিখতেন, আজ মৃতপ্রায়।
- যে খাটে কবি বাসররাত কাটিয়েছেন, তা এখন স্থানীয়দের ব্যবহার্য।
- পুকুরঘাট, রাজবাড়ি ও ঘরবাড়ির অবস্থা জরাজীর্ণ।
‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’র পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বলেন, “আমরা চাই দৌলতপুরে একটি পূর্ণাঙ্গ নজরুল জাদুঘর, পাঠাগার ও অতিথিশালা স্থাপন করা হোক।”
নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণের ইতিহাস
কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে কিছু উদ্যোগ:
- ১৯৬০: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কবি নজরুল ছাত্রাবাস’।
- ১৯৬২: নজরুল অ্যাভিনিউ নামকরণ।
- ১৯৭০: গঠিত হয় নজরুল ললিতকলা পরিষদ।
- ১৯৮৩ ও ১৯৯২: কবির পদচিহ্ন যেসব স্থানে রয়েছে, সেখানে স্থাপন করা হয় স্মৃতিফলক।
- বর্তমান: কবি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র, কুমিল্লা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এই ইনস্টিটিউটে রয়েছে নজরুল জাদুঘর ও পাঠাগার। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আল আমিন জানান, “মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছি।”
স্থানীয়দের আগ্রহ ও সম্পৃক্ততা
নজরুলচর্চায় কুমিল্লাবাসীর আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। আবৃত্তিশিল্পী কাজী মাহতাব সুমন বলেন, “বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নজরুল-সৃষ্টি সংরক্ষিত আছে কুমিল্লায়। তাঁর প্রেম, বিয়ে, প্রতিবাদ, গ্রেপ্তার সবকিছুর সাক্ষ্য আছে এই শহরে।”
স্থানীয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরাও নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, গবেষণায় আগ্রহী হচ্ছেন। অনুষ্ঠানকে ঘিরে কুমিল্লায় তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম কেবল বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি নন, তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কুমিল্লার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কুমিল্লায় জাতীয় অনুষ্ঠান শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি এক গভীর মূল্যবোধের প্রকাশ।
যদি নজরুলের স্মৃতিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও চর্চা করা যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে শুধু পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠায় নয়, বাস্তব চেতনার অংশ হিসেবে ধারণ করতে পারবে।