গাজার চিকিৎসক দম্পতির ৯ সন্তানের লাশ ফেরত এল ইসরায়েলি বোমায়

গাজার আল নাসের হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলা আল-নাজ্জার যখন জরুরি বিভাগে ডিউটি করছিলেন, তখনো হয়তো তিনি ভাবেননি যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নটি বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর নয়টি সন্তান প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছেন তাঁর স্বামী, যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক। একমাত্র বেঁচে থাকা সন্তানটিও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
এই মর্মান্তিক ঘটনা গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
ধ্বংসস্তূপে সন্তানদের মরদেহ: একটি মায়ের দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা
গত শুক্রবার (২৪ মে) খান ইউনিস শহরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আগুন ধরে যায় ডা. আলা আল-নাজ্জারের বাড়িতে। গাজার সিভিল ডিফেন্স বিভাগ জানায়, বিস্ফোরণের পর বাড়িটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। একের পর এক মরদেহ উদ্ধার করা হয় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে। তাদের মধ্যে ছিল সাতজন শিশু, যাদের মৃতদেহ নিজেই গ্রহণ করেন মা, যিনি তখন জরুরি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন।
পরবর্তীতে আরও দুই শিশুর মরদেহ পাওয়া যায় ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে। নিহত শিশুদের বয়স ছিল মাত্র ৭ মাস থেকে ১২ বছরের মধ্যে।
নিহত সন্তানদের নাম একে একে বললেন সহকর্মীরা
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ডা. মুনির আল-বারশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে জানান, নিহত নয়টি সন্তানের নাম হলো: ইয়াহিয়া, রাকান, রাসলান, জিবরান, ইভ, রাইভাল, সাইডেন, লুকমান ও সিদরা। তিনি বলেন, ‘‘এই যন্ত্রণা কোনো ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।’’
তিনি আরও লেখেন, ‘‘গাজার স্বাস্থ্যকর্মীরা শুধু চিকিৎসা দিচ্ছে না—তারা নিজের জীবন এবং পরিবার হারিয়ে দিচ্ছে এই যুদ্ধের বলি হয়ে।’’
একটি মাত্র সন্তান বেঁচে আছে, কিন্তু শঙ্কামুক্ত নয়
ডা. নাজ্জারের একমাত্র জীবিত সন্তান, ১১ বছর বয়সী আদম, বর্তমানে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি। তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আদমের বাবা, ডা. নাজ্জারের স্বামী, যিনি বাড়ি ফিরে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হামলার শিকার হন, তিনিও আইসিইউতে গুরুতর অবস্থায় আছেন।
নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আহমদ আল-ফাররা বলেন, ‘‘ডা. নাজ্জার একজন অকুতোভয় চিকিৎসক। সন্তান হারানোর পরও তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে স্বামী ও সন্তানের খোঁজ নিচ্ছেন, আবার রোগীদের সেবা দিচ্ছেন।’’
ইসরায়েলি বাহিনীর প্রতিক্রিয়া: ‘হামলার লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসীরা’
সিএনএন জানায়, তারা এই ঘটনায় আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী)-এর কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। তাদের বক্তব্য, ‘‘আমরা যে বাড়িগুলোতে হামলা চালিয়েছি সেগুলোর কাছ থেকে আমাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যক্রম চলছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। বেসামরিক প্রাণহানির বিষয়টি আমাদের জানা নেই, আমরা তদন্ত করবো।’’
কিন্তু বাস্তব চিত্র আরও নির্মম। হামলার সময় ওই বাড়িতে কোনো যোদ্ধা বা অস্ত্রের উপস্থিতির প্রমাণ মেলেনি। বরং একটি চিকিৎসক পরিবারের নয়টি শিশুকে একসঙ্গে হারানোর ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
উদ্ধারকার্য ও বিভীষিকাময় দৃশ্য
গাজার সিভিল ডিফেন্স একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায়—আগুনে জ্বলছে ভবন, ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনা হচ্ছে ছোট ছোট মরদেহ, যেগুলো সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হচ্ছে হাসপাতালের মেঝেতে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন নিঃশব্দে কাঁদতে থাকা মানুষ, আর চিকিৎসকরা ভেঙে পড়া চোখে এগুলো গ্রহণ করছেন।
এই দৃশ্য শুধু গাজার নয়, মানবতার।
স্বাস্থ্যখাতেও যুদ্ধ চলছে: চিকিৎসকরা আর ডাক্তার নন, যুদ্ধের সেনা
৩৮ বছর বয়সী ডা. আলা আল-নাজ্জার মূলত শিশু বিশেষজ্ঞ হলেও, গাজার চলমান সঙ্কট তাঁকে জরুরি বিভাগের যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে এনেছে।
ডা. ফাররা বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে গাজার হাসপাতালগুলো যেন সামরিক হাসপাতাল হয়ে উঠেছে। সব চিকিৎসকই যেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগী বাঁচানোর যুদ্ধে নেমেছে।’’
চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি, বিদ্যুৎ সংকট, ওষুধের অভাব—এসবের সঙ্গে লড়াই করেই চিকিৎসকরা কাজ করে যাচ্ছেন। এর ওপর যখন পরিবার হারানোর বেদনা যুক্ত হয়, তখন পরিস্থিতি হয়ে পড়ে অসহনীয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ
জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন গাজায় শিশু হত্যা এবং চিকিৎসাকর্মীদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলেছে, ‘‘শিশুরা কখনো যুদ্ধের পক্ষ হতে পারে না। তাদের রক্ষা করা মানবিক দায়িত্ব।’’
গাজার জনগণের আর্তনাদ: কবে শেষ হবে এই দুঃস্বপ্ন?
গাজায় ইসরায়েলি হামলা প্রতিদিনই নতুন নতুন দুঃসংবাদ নিয়ে আসছে। কখনো হাসপাতালে বোমা, কখনো স্কুলে, কখনো শরণার্থী শিবিরে। এখন চিকিৎসকদের বাড়িতেও হামলা চলছে।
ডা. আলা আল-নাজ্জারের কাহিনি কোনো একক ঘটনা নয়, বরং গাজার হাজারো পরিবার যে ভয়ংকর বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা-ই তুলে ধরে।