ভারত-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ এক মাস বাড়লো

অবিরাম উত্তেজনার ছায়ায় দক্ষিণ এশিয়া, আকাশসীমা ব্যবহারে ভারত ও পাকিস্তানের নতুন কৌশল
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা থামছে না। এবার একে অপরের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও এক মাস বাড়িয়েছে দুই দেশ। ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত উড়োজাহাজ চলাচলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলোর জন্য।
গতকাল শুক্রবার (২৩ মে) পাকিস্তান এয়ারপোর্টস অথরিটি (পিএএ) এবং ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় এই নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।
পাকিস্তানের ঘোষণা: ২৪ জুন পর্যন্ত ভারতের উড়োজাহাজ নিষিদ্ধ
পাকিস্তান এয়ারপোর্টস অথরিটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভারতীয় নিবন্ধিত, পরিচালিত বা মালিকানাধীন সব উড়োজাহাজ—যাতে সামরিক ফ্লাইটও অন্তর্ভুক্ত—আগামী ২৪ জুন ভোর ৪টা ৪৯ মিনিট পর্যন্ত পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। এতে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা ভূমি থেকে শুরু করে ‘সীমাহীন উচ্চতা’ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে আকাশসীমা বন্ধ থাকবে ভারতের জন্য।
এই নির্দেশনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ভারতীয় উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ বা অতিক্রম করতে পারবে না। তবে অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে না।
ভারতের পাল্টা সিদ্ধান্ত: পাকিস্তানের বিমান চলাচলে একই রকম নিষেধাজ্ঞা
ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকেও একই রকম এক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এসেছে। পাকিস্তানে নিবন্ধিত, পরিচালিত, মালিকানাধীন বা ইজারা নেওয়া সব উড়োজাহাজ ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে পারবে না ২৩ জুন পর্যন্ত। সামরিক ফ্লাইটও এর বাইরে নয়।
কী ঘটেছিল মূলত?
উল্লেখযোগ্য যে, গত এপ্রিল মাসে ভারতের কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় এক প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে, যার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেই দায়ী করে ভারত। এরপরই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে এবং ১ মে ২০২৫ থেকে ভারত প্রথমে পাকিস্তানের উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও একই পদক্ষেপ নেয়।
এ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কোথায়?
আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে reroute ও সময় বৃদ্ধি
দুই দেশের আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে বিকল্প রুটে যেতে হচ্ছে। এতে জ্বালানি খরচ, উড়ানের সময় এবং টিকিটের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আসা ফ্লাইটগুলোর ওপর প্রভাব পড়েছে বেশি।
বাণিজ্যিক ক্ষতি
- পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (PIA) এবং এয়ার ইন্ডিয়ার মতো রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর রুট পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন কয়েক কোটি রুপির অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।
- আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইটেও সময় ও খরচ বাড়ছে।
কূটনৈতিক বার্তায় কী বলা হচ্ছে?
ভারতের পক্ষ থেকে এ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক মন্তব্য আসেনি। তবে পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ডনের কাছে বলেন, “ভারতের আচরণ একতরফা ও উত্তেজনামূলক। আকাশসীমা বন্ধের সিদ্ধান্ত পাকিস্তান কখনোই চায়নি।”
অন্যদিকে ভারতের একটি প্রতিরক্ষা সূত্র জানিয়েছে, “পাকিস্তানকে তার সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার খেসারত দিতে হবে। শুধু সীমান্তে নয়, আকাশপথেও আমরা কূটনৈতিক বার্তা দিচ্ছি।”
কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় ও পাকিস্তানি উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর তুলনায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলো, বিশেষ করে কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের মতো সংস্থাগুলো।
এর আগে ২০১৯ সালেও বালাকোট হামলার পর দীর্ঘ সময় দুই দেশের আকাশসীমা বন্ধ ছিল, যা ভারতের বিমান সংস্থাগুলোর প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি করেছিল। এবারও একই পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু নিরাপত্তা নয়, বরং কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই চাইছে পরস্পরকে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিব্রত করতে।
দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক রাহুল বক্সী বলেন, “আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞা কেবল প্রতীকী নয়, বাস্তব দিক থেকেও তা বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এ সিদ্ধান্ত দীর্ঘ হলে চীনের মতো তৃতীয় পক্ষের লাভ হবে। কারণ, বিকল্প ট্রানজিট চ্যানেল হিসেবে চীন নিজেকে তুলে ধরতে পারে।”
এখন কী হতে পারে?
বর্তমানে এই নিষেধাজ্ঞা ২৩-২৪ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছে। তবে আলোচনার অগ্রগতি না হলে পরবর্তী সময়েও এর মেয়াদ আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞা শুধু দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপড়েনের প্রতিফলন নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পর্যটন ও নিরাপত্তার ওপরও বড় প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে, এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, পুরো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।