বানিজ্য

বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়াচ্ছে ইউরোপের লুইস ড্রেইফাস কোম্পানি

১৭ কোটির বাজারে শক্ত অবস্থান নিতে চায় বহুজাতিক কৃষিপণ্য সরবরাহকারী এই প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশে কৃষিপণ্য আমদানির বাজারে অন্যতম আলোচিত নাম হয়ে উঠছে ইউরোপভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘লুইস ড্রেইফাস কোম্পানি’ বা এলডিসি (LDC)। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্বব্যাপী সরবরাহে ১৭৪ বছরের পুরোনো এই কোম্পানিটি বাংলাদেশে নিজেদের ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারণ করছে।

২০২২ সালে ঢাকায় অফিস খোলার মধ্য দিয়ে এলডিসির বাংলাদেশ যাত্রা শুরু হয়। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে এখন তারা দেশে নিজেদের সরবরাহব্যবস্থা আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছে। তাদের লক্ষ্য—দেশীয় ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষিপণ্য সরবরাহ সহজ করা এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে কৃষিপণ্য পৌঁছে দেওয়া।

কে এই লুইস ড্রেইফাস কোম্পানি (LDC)?

লুইস ড্রেইফাস কোম্পানি একটি ফ্রান্সভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, যার সদরদপ্তর রয়েছে রটারড্যামে। কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রপ্তানিতে এরা বিশ্বে অন্যতম প্রভাবশালী। বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। তারা মূলত শস্য, তেলবীজ, চিনি, তুলা, কফি, রাবার, চাল ইত্যাদি সরবরাহ করে।

ভারতের মতো দেশে তাদের রয়েছে কফি ও ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। ১৯৯৭ সাল থেকে তারা ভারতের বাজারে কাজ করছে।

বাংলাদেশে এলডিসির কার্যক্রম

২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ‘লুইস ড্রেইফাস কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে তারা বাংলাদেশে অফিস খোলে। তখন থেকেই তারা কৃষিপণ্য আমদানির বাজারে সক্রিয় হয়।

এখন তারা সরাসরি নিজস্ব উৎস থেকে পণ্য এনে স্থানীয় ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছে। এ বিষয়ে এলডিসির দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান রুবেন্স মার্কেস বলেন—

“বাংলাদেশে ছোট ও মাঝারি প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানগুলো বড় পরিসরে আমদানি করতে পারে না। তাদের জন্যই আমরা সরাসরি আমদানির মাধ্যমে কৃষিপণ্য সরবরাহ সহজ করতে চাই। এতে দেশের ভোক্তারাও সারাবছর প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য পাবেন।”

কৃষিপণ্য আমদানির বিশাল বাজার

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি হয়। খাদ্যশস্য, প্রাণিখাদ্য, বস্ত্র খাতের কাঁচামাল ও ভোজ্যতেলসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্য আসে এই আমদানির আওতায়।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে ১ হাজার ৫০৬ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য আমদানি হয়। এর মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের পণ্য সরবরাহ করেছে এলডিসি। তারা ১৯টি দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করেছে, যার ৬৫ শতাংশ এসেছে ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

কারা এলডিসির নিয়মিত গ্রাহক?

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী যেমন:

  • মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (MGI)
  • সিটি গ্রুপ
  • টি কে গ্রুপ
  • বাদশা গ্রুপ

এরা এলডিসির নিয়মিত ক্রেতা। প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত এলডিসির মাধ্যমে গম, সয়াবিন বীজ, ভুট্টা, ক্যানোলা বীজ, অপরিশোধিত চিনি, সয়া কেক ও তুলা আমদানি করে।

কেন বাংলাদেশে এলডিসি আগ্রহী?

বাংলাদেশ একটি ১৭ কোটির বেশি মানুষের বাজার। দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, এবং খাদ্যপণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধির ফলে কৃষিপণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। এলডিসি মনে করছে, এখানে তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

রুবেন্স মার্কেস বলেন—

“আমরা বাংলাদেশে পণ্যভিত্তিক সরবরাহ বাড়াতে চাই। শুরুতে খাদ্যশস্য, তেলবীজ ও ডাল আমদানির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। এরপর ধাপে ধাপে অন্য পণ্যও সরবরাহ করব।”

বস্ত্রশিল্প ও তুলা আমদানি

বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় তুলা—বিশেষ করে বস্ত্রশিল্পের জন্য। ২০২৪ সালে ৩৭৪ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ। ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে তুলা আনতে এক থেকে দুই মাস সময় লাগে।

এ কারণে এলডিসি তুলার সরবরাহব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। তারা এমন একটি ব্যবস্থা গড়তে চায়, যাতে স্থানীয় তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানাগুলোর মূলধন আটকে না থাকে এবং সময়মতো কাঁচামাল পায়।

ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য সম্ভাবনা

বাংলাদেশে এখন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বড় কোম্পানিগুলো জাহাজ ভাড়া করে আমদানি করতে পারলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সামর্থ্য রাখে না।

এলডিসি চায়—তাদের বাংলাদেশ অফিসের মাধ্যমে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সরাসরি আমদানিকৃত কৃষিপণ্য কিনতে পারুক। এতে করে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে, দাম কমবে, এবং বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে।

বিশ্বজুড়ে এলডিসির প্রভাব

  • বিশ্বের ১০০+ দেশে কার্যক্রম
  • শস্য, ভোজ্যতেল, চিনি, কফি, তুলা, ডাল, প্রাণিখাদ্য ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি
  • সিঙ্গাপুর, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ বহু দেশে স্থায়ী কার্যালয়

বাংলাদেশে দ্রুত বাড়তে থাকা কৃষিপণ্য আমদানির বাজারে শক্ত অবস্থান নিতে চায় লুইস ড্রেইফাস কোম্পানি। তারা সরাসরি পণ্য আমদানি করে স্থানীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে কৃষিপণ্য খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চায়।

এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, কাঁচামালের যোগান ব্যবস্থায় গতিশীলতা আসবে এবং পণ্যদামের ওপর চাপও কিছুটা কমবে। এলডিসির এই পদক্ষেপ কৃষি, খাদ্য এবং শিল্পখাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button